উত্তর-আধুনিকতাবাদ; পর্ব-১
[Pos-Modernism; Part-1]
Literary Theory: A Guide for the Perplexed By Mary Klages Continuum Press, January 2007
একটি পদ হিসেবে ‘আধুনিক’ বা modern শব্দটি আবির্ভূত হয় ১৬ শতকের শেষ ভাগে। কথাগুলো রেমন্ড উইলিয়ামসের, যিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত মার্ক্সবাদী সাহিত্য তাত্ত্বিক, সাহিত্য সমালোচক। তিনি তাঁর ‘Key Words. A Vocabulary of culture and society’ গ্রন্থে বলেছেন যে, modern শব্দটি যখন উদ্ভূত হলো তখন এটি বোঝাতো “বর্তমান”কে, “এখন”কে। তার মানে হচ্ছে, আধুনিক শব্দের সাথে ইতিহাসের ধারণা যুক্ত। আধুনিক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছিল “যা কিছু অতীত” তার থেকে একটি সীমারেখা, একটি ভিন্নতা স্পষ্ট করার জন্য। যা দিয়ে বোঝানো হয় মধ্যযুগীয় নয়, আধুনিকের মানে হচ্ছে অতীত নয়। অর্থাৎ আধুনিক শব্দের সাথে ইতিহাস, সময়, কাল, যুগ – এগুলো যুক্ত। উত্তর-আধুনিকতাবাদ কিন্তু আধুনিকের পরের কোন পর্বকে নির্দেশ করেনা। আধুনিকতাবাদী চিন্তুকদের মতে, আধুনিকতাবাদ বা modernism হচ্ছে একটি দৃষ্টিভঙ্গী, একটি মনোভঙ্গী। একই সাথে কিছু চিন্তুক বলছেন, উত্তর-আধুনিকতাবাদও হচ্ছে একটি দৃষ্টিভঙ্গী এবং একটি মনোভঙ্গী।
উত্তর আধুনিকতাবাদ একটি জটিল বিষয়। কিংবা অন্যভাবে বললে উত্তর আধুনিকতাবাদ হলো এক সেট ধারণা। এর আবির্ভাব মূলত আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে একাডেমিক গবেষণার পরিসরে। উত্তর আধুনিকতাবাদকে কোন সংজ্ঞায় বেঁধে ফেলা সম্ভব নয়। কেননা বিভিন্ন জ্ঞানকান্ডে এটি এসেছে- বিশেষভাবে বললে – শিল্প, স্থাপত্য, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, সাহিত্য, সামাজিক বিজ্ঞান, যোগাযোগ, ফ্যাশন এবং প্রযুক্তি ইত্যাদি ক্ষেএে। এই ধারণাকে ঐতিহাসিকভাবে স্থাপন করা যায় না কেননা ঠিক কবে থেকে উত্তর-আধুনিক ধারণার সূত্রপাত হয়েছে তা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায় না। তিনি তাঁর লেখায় বলতে চেয়েছেন উত্তর-আধুনিকতাকে বুঝবার জন্য আমাদেরকে প্রথমেই আধুনিকতাকে বুঝতে হবে, কেননা এর মধ্য থেকেই উত্তর-আধুনিকতার যাত্রা শুরু হয়েছিল।
আধুনিকতাবাদ হলো একটি নান্দনিক আন্দোলন (aesthetic movement)। এই আন্দোলন ছিলো চিত্রশিল্প, সঙ্গীত, সাহিত্য, নাটক ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে পুরাতন ভিক্টোরিয়ান সময়কালের ধ্যান-ধারণাকে খারিজ করা হয় আর এ সকল ক্ষেত্রেই নতুন ধারার প্রবর্তন করা হয়। এ সময় ১৯১০-১৯৩০ পর্যন্ত সময়কালকে period of “high modernism” বলা হচ্ছে। এ সময়ের তাত্ত্বিকেরা হলেন Woolf, Joyce, Eliot, Pound, Stevens, Proust, Mallarme, Kafka, and Rilke যাদেরকে বিংশ শতাব্দীর আধুনিকতাবাদের প্রবক্তা বলা হয়।
লেখক আধুনিকতাবাদের কিছু বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেন ঃ
১. এরা impressionism এবং subjectivity’র উপর গুরুত্ব দিতো। তারা কি দেখি এই প্রশ্নের উপর জোড় না দিয়ে আমরা কিভাবে দেখি তার উপর জোড় দিতো।
২. objectivity হতে দূরে সরার কথা বলা হচ্ছিল এবং সবকিছু বিমূর্তভাবে উপস্থাপনের কথা বলা হচ্ছিল।
৩. বিভিন্ন ধরন – এর পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছিল। যেমনঃ উপন্যাসগুলো হবে কবিতার মতো এবং কবিতা হবে ডকুমেন্টারীর মতো।
৪. নতুন fragmented forms তারা গ্রহন করেছিল।
৫. reflexivity বা আত্মসমালোচনামূলকতার উপর জোর দিয়েছিলো যাতে কবিতা, গল্প, উপন্যাস – এ তাদের নিজেদের আকৃতিকে সামনে তুলে ধরেছিলো।
৬. জন সংস্কৃতিতে “high” এবং “low” – এই ধারণাকে তারা খারিজ করেছিলো।
উত্তর-আধুনিকতাবাদ আধুনিকতাবাদের প্রায় সকল ধারণাকেই অনুসরণ করে, তারা শিল্পকলার ক্ষেত্রে high and low forms এর বিভাজনের ধারণাকে খারিজ করেন, pastiche, parody, bricolage, irony, and playfulness এর উপর জোর প্রদান করেন। উত্তর-আধুনিকতাবাদ এ শিল্পকলার ক্ষেত্রে reflexivity বা আত্মসমালোচনামূলকতার উপর জোর দেওয়া হয়। এছাড়া জোর দেওয়া হয় destructured, decentered, dehumanized subject এর উপর।
কিন্তু এইভাবে আধুনিকতাবাদ এবং উত্তর-আধুনিকতাবাদকে একই মনে হলেও এটি দৃষ্টিভঙ্গী, মনোভঙ্গীর (ইংরেজিতে যাকে বলা হচ্ছে attitude) দিক দিয়ে আধুনিকতাবাদের চেয়ে ভিন্নতা পোষন করে। আধুনিকতাবাদ human subjectivity এবং ইতিহাসের একটি খন্ড চিত্র পরিবেশন করতে চায় কিন্তু কিছু সময় এই খন্ড চিত্র পরিবেশন দুঃখজনক, একটি ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করে এখানে শোক করা হয়। অনেক আধুনিকতাবাদী তাত্ত্বিক এই ধারণাকে পোষন করেন যে, শিল্পকলা নিযে কাজ মানুষকে একত্রিত থাকতে সহায়তা করে। শিল্পকলা তাই করে যা মানুষের প্রতিষ্ঠান করতে পারেনা। পক্ষান্তরে উত্তর-আধুনিকতাবাদ এই খন্ড চিত্র, অনঐক্যতা নিয়ে শোক না করে বরং একে celebrate করে। তারা বলেন, এই বিশ্বই হলো অর্থহীন? তাই শিল্পকলা কোন অর্থ তৈরী করতে পারে এমন ধারণাই অযৌক্তিক। তারা বলেন,‘let’s just play with nonsense.’
আধুনিকতাবাদ এবং উত্তর-আধুনিকতাবাদের মধ্যকার সম্পর্ককে দেখবার ভিন্ন একটি দৃষ্টিভঙ্গী এ বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করবে। Frederic Jameson এর মতে, আধুনিকতাবাদ এবং উ
আধুনিকতাবাদ এবং উত্তর-আধুনিকতাবাদ হলো একটি সাংস্কৃতিক গঠন যা পুঁজিবাদের নির্দিষ্ট ধাপের সাথে জড়িত। তিনি পুঁজিবাদের তিনটি প্রাথমিক ধাপের কথা উল্লেখ করেন যা নির্দিষ্ট ধরণের সাংস্কৃতিক চর্চাকে নির্দেশ করে (এখানে এ সময়ে যে সকল শিল্পকলা ও সাহিত্য লেখা হয়েছে তাও অন্তর্ভুক্ত)।
১. প্রথমটি হলো market capitalism, যা আঠার শতক থেকে শুরু হয়ে উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপ, ইংল্যান্ড এবং আমেরিকাতে সংঘটিত হয়েছিলো। এই ভাগে রয়েছে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন (steam-driven motor) এবং একটি নির্দিষ্ট ঢংয়ের নান্দকিতা যাকে বলা হচ্ছে realism।
২. দ্বিতীয়টি হলো monopoly capitalism, দ্বিতীয় ধাপের শুরু হয় উনিশ শতকের শেষ থেকে এবং যা চলছিলো বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এই ভাগে রয়েছে electric and internal combustion motors এবং আধুনিকতা।
৩. তৃতীয়টি হলো multinational or consumer capitalism, এটি হলো বর্তমান সময় যেখানে পণ্য উৎপাদনের চেয়ে পণ্য বাজারজাতকরণ, বিক্রি এবং ভোগের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। যার সাথে জড়িত পারমাণবিক এবং বৈদ্যুতিক প্রযুক্তি এবং যার সাথে উত্তর-আধুনিকতাবাদ ওতোপ্রতোভাবে জড়িত।
Jameson – এর এই এপ্রোচ উত্তর-আধুনিকতাবাদকে একটি সমগ্র সামাজিক কাঠামো বা সামাজিক/ঐতিহাসিক আচরণের একটি সেট হিসেবে উপস্থাপন করে যেখানে “postmodernism” এবং “modernism” তুলনার চাইতে “post-modernity” এবং “modernity” এর মধ্যকার তুলনাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
সাধারনভাবে আধুনিকতাবাদ বিংশ শতকের একটি বিস্তৃত নান্দনিক আন্দোলনকে নির্দেশ করে। “modernity” এক সেট দার্শনিক, রাজনৈতিক এবং নৈতিক ধারণাকে নির্দেশ করে যা আধুনিকতাবাদের নান্দনিকতার ধারণার ভিত্তি রচনা করে। “modernity” আধুনিকতাবাদের চেয়ে পুরানো ধারণা। “modern” এই প্রত্যয়টি উনিশ শতকে প্রথম ব্যবহৃত হয় সমাজবিজ্ঞানে, এটি ব্যবহৃত হয় পূর্ববর্তী সময় থেকে বর্তমান সময়ের পার্থক্য করার জন্য যাকে প্রকাশ করা হয় “antiquity” শব্দটি দিয়ে। ঠিক কখন থেকে “modern” বা আধুনিক সময়কালের শুরু হয় এবং কাকে আমরা “modern” বলবো আর কাকে বলবো না তা নিয়ে তাত্ত্বিকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। সাধারনভাবে আধুনিক সময় কালের সূত্রপাত ইউরোপিয়ান এনলাইটেনমেন্ট এর ধারণার সাথে জড়িত যা আঠার শতকের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়।
উত্তর-আধুনিকতাবাদ জ্ঞান উৎপাদনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে। আধুনিক সমাজে জ্ঞান আবশ্যিকভাবেই বিজ্ঞানের সাথে জড়িত এবং যাকে বয়ান (narrative) এর সাথে তুলনা করা হয়। এখানে বিজ্ঞানকে ভালো আর বয়ানকে খারাপ, আদিম, অযৌক্তিক বলে বিবেচনা করা হয়। একজন শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে জ্ঞান আহরণ করে নিজেকে শিক্ষিত করে তোলে। উত্তর-আধুনিক সমাজে, জ্ঞান অনেকাংশেই functional – একজনকে কোন জিনিস শিখতে হয় তাকে জানতে হয় না কিন্তু এই জ্ঞানকে ব্যবহার করতে হয়। Sarup উল্লেখ করেন যে, বর্তমান সময়ের শিক্ষা নীতি দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের উপর জোর দেয়। অন্য একটি পরিসরে উত্তর-আধুনিকতাবাদ ভোগের বৈশ্বিক সংস্কৃতিতে অংশগ্রহনের রাস্তা বাতলায়, যেখানে পন্য এবং জ্ঞানের কাঠামো বা ধরন সম্পর্কে বহু দূর থেকে প্রস্তাবনা দেওয়া হয় আর যেখানে কোন ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ থাকেনা। উত্তর-আধুনিকতাবাদী রাজনীতিবিদরা স্থানীয় অবস্থাকে তত্ত্বীয়ভাবে খুবই তরল করে ব্যাখা করে যেখানে বৈশ্বিকতার প্রভাব থাকে। তাদের মন্ত্র হলো “think globally, act locally”.
উপরোক্ত লেখাটির সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষে আমি বলতে চাই যে, লেখাটিতে লেখক বেশ দক্ষতার সাথেই আধুিনকতাবাদ এবং উত্তর-আধুনিকতাবাদ এই বিষয়গুলোকে স্পষ্ট করে তুলেছেন। এ কথাটি পরিষ্কার যে, আধুনিকতাবাদকে বোঝা ছাড়া কোনভাবেই উত্তর-আধুনিকতাবাদকে বোঝা সম্ভব নয়। বিংশ শতাব্দীর সংস্কৃতিকে বুঝতে আধুনিকতাবাদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে উত্তর-আধুনিকতাবাদ মূলত ৮০’র দশকের। মূলত বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে আধুনিকতাবাদ একটি নান্দনিক আন্দোলন হিসেবে আবির্ভূত হয়, যেটি সে সময়ের শিল্প ও সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রন করেছে। মোদ্দা কথা আধুনিকতাবাদকে বোঝা ছাড়া বিংশ শতাব্দীর সংস্কৃতিকে বোঝা রীতিমত অসম্ভব। আধুনিকতাবাদ একভাবে ইতিহাসের খন্ডিত চিত্র পরিবেশন করে এবং এর জন্য তারা বিলাপও করে পক্ষান্তরে উত্তর-আধুনিকতাবাদ এই খন্ডায়নকে উৎযাপন করে। আধুনিকতাবাদের মতো উত্তর-আধুনিকতাবাদও এক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী, মনোভঙ্গী। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, আধুনিক মনোভঙ্গী বলতে বোঝানো হয়েছে বিশেষ কিছু বৈর্শিষ্ট্যাবলীকে। যেমন ঃ নতুনত্ব তৈরী, পুরাতনকে ভেঙ্গে ফেলা, জনসংস্কৃতি হতে দূরত্ব ইত্যাদি। আধুিনকতাবাদ এবং উত্তর-আধুনিকতাবাদ দু’টোকেই আমরা একটি আন্দোলন হিসেবে দেখতে পাই। দু’টো আন্দোলনই বিংশ শতকের শিল্পকলা ও সংস্কৃতির খন্ডিত রূপের উপর গুরুত্বারোপ করলেও, এটি তারা করেছে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ থেকে।
শু
No comments:
Post a Comment