বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন ২০০১ (Bangladesh Disability Welfare Act, 2001) এ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংজ্ঞা প্রদান ও আইনটি যথাযথ বাস্তবায়ন ও তদারকী করার জন্য কমিটি গঠনের পাশাপাশি এই আইনে প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ, প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ ও প্রতিবন্ধিতা প্রতিকারের কথা বলা হয়েছে।
আইনে সুস্পষ্টভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ৭টি সেবার কথা উল্লেখ আছে। যথা:
১. প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষা সেবা,২. প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য সেবা,৩. প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থান,৪. যাতায়াত সুবিধা, ৫. ক্রীড়া ও সংস্কৃতি, ৬. সামাজিক নিরাপত্তা, ৭. প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিজস্ব সংগঠন।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সংরক্ষণ ও সমান সুযোগ-সুবিধার নিশ্চিতের কথা সময় সময়ে প্রশাসনিক আদেশেও লক্ষ্য করি। যেমনঃ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরিপত্র/৭-৩-২০০২: ১. যানবাহনে যাতায়াত সহজ করার জন্য পৃথক টিকিট কাউন্টার (বাস, লঞ্চ, ট্রেন, বিমান), ২. যানবাহনে যাতায়াত সহজ করার জন্য আসন সংরক্ষণ (বাস, লঞ্চ, ট্রেন, বিমান), ৩. ১০% কোটা ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর চাকুরিতে, ৪. ১ম ও ২য় শ্রেণীর চাকুরিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ১% কোটা (সরাসরি নয়), ৫. র্যাম্প স্থাপন (ঢালুসিড়ি), ৬. সরকারী অফিসে হয়রানি বন্ধ করা। দেশের সকল সরকারী অফিস- আদালতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সহজ যাতায়াত প্রসঙ্গে-মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ/২০০৫: সরকারি বেসরকারি সকল স্থাপনায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সহজ চলাচলের জন্য ঢালু পথ বা (Ramp) স্থাপন করা, যেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণ সরাসরি যাতায়াত করতে পারবেন।
আরো বহু ধরণের আইন আছে এদেশের বিভিন্ন ধরণের প্রতিবন্ধিতার শিকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিভিন্ন ধরণের চাহিদা অনুযায়ী। তার মধ্যে দেশের যাতায়াত ব্যবস্থা সংক্রান্ত আইন পর্যাপ্ত নয় বলেই মনে করি। একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির যাত্রীর অধিকারকে রক্ষা করে এমন আইন এখনো বাংলাদেশে নেই।
ধরুন আপনি একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তি। আপনি ঘরের বাইরে বের হবেন কিভাবে? বাইরের জগতের সাথে সম্পৃক্ত হবার জন্য একজন প্রতিবন্ধী তথা হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীকে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। যাতায়াতের জন্য পাবলিক বাসের কথা আসলে যেটা প্রায়ই শুনতে হয় তা হলো – অপ্রতিবন্ধী মানুষই বাসে চড়তে ধাক্কাধাক্কি, সেখানে আবার হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী! এদেশের বাসগুলোতে না আছে কোন র্যাম্প না আছে হুইলচেয়ার নিয়ে বসার জন্য আলাদা জায়গা। অথচ অনায়াসেই আমাদের বিআরটিসি বাসে স্বল্প সময়ে কম খরচে র্যাম্প সংযোজন করে বাসের ভিতর ২/১টা সিট উঠিয়ে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের জন্য সুন্দর বসার ব্যবস্থা করা যায়। হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী মানুষগুলো আসলে কতটা অসহায়, ইচ্ছে থাকলেও ঘরের বাইরে পরিবেশে তারা চলাচল করতে অপারগ শুধুমাত্র একটুখানি সহায়ক ব্যবস্থা আর দৃষ্টিভঙ্গীর অভাবে!
এখানে উল্লেখ্য যে, সরকারি পরিপত্রে বলা হয়েছে, আন্তঃজেলা বিআরটিসি বাসে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ২টি সীট সংরক্ষিত থাকবে এবং নগর পরিবহনে যতজন বাসে আরোহণ করবেন ততজনকেই আসন দিতে হবে। সরকারী যানবাহন তথা বাস, ট্রেন ইত্যাদিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণ তাদের পরিচয় পত্র প্রদানপূর্বক অর্ধেক ভাড়ায় ভ্রমণ করতে পারেন। এমনকি, মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এর ৬০(৩)(xxll) ধারার স্টেজ ক্যারেজ (বাস/মিনিবাস ইত্যাদি) এর রুট পারমিট অনুমোদনের ক্ষেত্রে আরোপযোগ্য শর্তসমূহের আলোকে ২৯-০৩-২০০৮ তারিখে অনুষ্ঠিত ঢাকা মেট্রোপলিটন আঞ্চলিক পরিবহন কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা শহরে যে বাসগুলো চলে তার ৯ টি এবং মিনি বাস হলে ৬টি সিট নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য সংরক্ষিত রাখার অনুরোধ করা হয়। আর এই বিষয়টি আমরা অনেকেই হয়তো জানি না বা জানলেও মানি না। এটা মানার অভ্যাস তৈরী করা দরকার। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য যাও বা সংরক্ষতি আসন আছে কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধী তথা হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তির জন্য সেই আসনগুলোতে উঠে বসার কোনই ব্যবস্থা নেই। তারা কি তবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে কি গণ্য নন!? যদি হয়ে থাকেন তাহলে তাদের জন্য বাস, ট্রেন, লঞ্চ ইত্যাদিতে সহজে উঠে বসার সুব্যবস্থা কেন নেয়া হচ্ছে না?
সারা দেশে বিআরটিসি এর শহস্রাধিক বাস চলাচল করে। এর একটিতেও কি হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের সহজে প্রবেশের জন্য সহায়ক ব্যবস্থা তৈরির উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে না? আমরা সকলে কি এটা নিয়ে সম্মিলিতভাবে কিছু করতে বা ভাবতে পারি না!
বাধামুক্ত চলাচলের কথা বলতে গেলে প্রাসঙ্গিকভাবেই চলে আসে ফুটপাথের কথাও। ক্লান্ত পথিক, বৃদ্ধ, অসুস্থ রোগী, মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের পথে ফুটওভার ব্রিজ অতিক্রম করা সম্ভব নয়। একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীকে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করতে বাধ্য করা আইনতঃ বাংলাদেশ সংবিধানের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার অনুচ্ছেদ – ১১, কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তি অনুচ্ছেদ ১৪, সুযোগের সমতা অনুচ্ছেদ -১৯ (১) (২), আইনের দৃষ্টিতে সমতা অনুচ্ছেদ – ২৭, জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধকরণ অনুচ্ছেদ – ৩৪ (১), চলাফেরার স্বাধীনতার অনুচ্ছেদ -৩৬ এর পরিপহ্নী। পথচারীদের অধিকার বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের আইন-২০০৯ এর তৃতীয় তফসিল ১৯.১ এ বলা হয়েছে পথচারী যাহাতে পথ চলিতে বাধাগ্রস্ত না হন এবং তাহারা নিরাপদ ও অনায়াসে পথে চলাচল করিতে পারে সেই জন্য কর্পোরেশন প্রবিধান দ্বারা যানবাহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবে। পথচারীদের নিরাপদে যাতায়েতে সমান্তরাল জেব্রা ক্রসিং, সিগন্যাল, হকার ব্যবস্থাপনা, বাথরুম ও ছায়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করিবে। কিন্তু বাস্তবে এমন কোন ফুটপথ পাওয়া যাবে না যা ব্যবহার করে একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী কিছুদূর পথ চলতে পারে। নিশ্চিত বাধাগ্রস্ত হবেন ছোটবড় খানা-খন্দকে, বিভিন্ন ভবনের মালিক নিজেদের মতো করে নির্মণ সামগ্রী ফেলে ফুটপাত দখল করে নিয়েছেন, বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক খোঁড়াখুঁড়ি আর সংস্কার হচ্ছে প্রতিনিয়ত, ফলে সড়কের সঙ্গে ফুটপাতের যে অ্যালাইনমেন্ট থাকার কথা, সেটা নষ্ট হয়েছে। অধিকন্তু প্রয়োজনীয় ফুটপাথের দুদিকেই ঢালু না থাকায় একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী পারছেন না ফুটপথ ব্যবহার করতে আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মত। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সহজ চলাচলে দিক নির্দেশনা সংক্রান্ত ব্রেইল ব্লকের ব্যাপারেও কোথাও উল্লেখ নেই। আমাদের দেশের মানুষের মাঝে ধারণাই নেই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কারো সাহায্য ছাড়াই ব্রেইল ব্লক এর সাহায্য ফুটপাথ, জেব্রা ক্রসিং রাস্তা পারাপারসহ বিভিন্ন জায়গায় একা একাই চলাচল করতে পারেন।
এ সকল আইনের সফল পরিপূর্ণ কাঠামো হচ্ছে আইনী কাঠামোগত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ সনদ (Convention On The Rights Of Persons With Disabilities- CRPD) যা ২০০৬ সালে গৃহীত হয়। বাংলাদেশ ৯ মে ২০০৭ সালে এই সনদে স্বাক্ষর করে এবং একই বছর ৩০ নভেম্বর তা অনুমোদন করে। এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশ এর অনেক আগেই ২০০১ সালের প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন পাশ করে যা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষায় একটি মাইলফলক। বর্তমানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরামের সহযোগিতায় সিআরপিডির আদলে “বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষা আইন ২০১৩” এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে যা এখন সংসদ কর্তৃক অনুমোদনের অপেক্ষায়। এই আইন পাসের পর নীতিগতভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কাজ করার দায়বদ্ধতা তৈরি হবে আশা করি। যদিও এই খসড়া থেকে কমিশন বাদ দেয়া হয়েছে।
প্রথমে ‘মানুষ’ এবং পরে তার ‘প্রতিবন্ধিতা’, এ উপলব্ধি থেকে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে তাদের মূল ধারায় নিয়ে আসতে উন্নত বিশ্বে আজ শিক্ষা, রাস্তাঘাটে আলাদা সীমানা, অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা দানসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে, তাদের উন্নয়নের মূল ধারায় প্রবেশ করিয়ে দক্ষ শ্রমশক্তিতে পরিণত করা হয়েছে। এছাড়াও ওই দেশসমূহে প্রতিবন্ধী মানুষেরা শক্ত সামাজিক নিরাপত্তা ঘোষণার মধ্যে থাকায় তাদের নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত হয় এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। উদাহরণ স্বরূপ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন, নরওয়ের কথা বলা যায় সেখানে প্রতিবন্ধী মানুষেরা স্বচ্ছন্দে চলাচল করতে পারেন, বাসে, ট্রামে, মেট্রোরেলে-সাবওয়েতে ভ্রমণ, বিভিন্ন ব্যাংক বীমা, বিশ্ববিদ্যালয়ে সহজে প্রবেশের জন্য সবধরনের অবকাঠামোগত সুবিধাদি সংযুক্ত রয়েছে, ফলে একজন প্রতিবন্ধীকে অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয় না।
আপনি আমি মিলেই সমাজ। প্রতিবন্ধী তথা ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তিরাও সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এদেশের প্রতিবন্ধী মানুষেরা প্রয়োজনীয় সুযোগ ও সমর্থন পেলে সমাজের অন্যান্য সকলের মতো তারাও কর্মদক্ষতা ও সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিতে পারে। শুধুমাত্র সর্বজনীন প্রবেশগম্যতার সু-ব্যবস্থা না থাকার মত প্রতিবন্ধকতাই আজ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে যেমন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করছে তেমনি যোগ্য প্রতিবন্ধীকে কর্মসংস্থান তথা সকল প্রকার উন্নয়ন কর্মকান্ড থেকে বঞ্চিত রাখছে। উন্নত বিশ্বে আজ প্রতিবন্ধিতা কোনো সমস্যা নয়। কেননা তারা তাদের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে উপযুক্ত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে তাদের সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে এসেছে। উন্নত বিশ্বের ন্যায় আমরাও আমাদের দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নের মূল ধারায় নিয়ে আসতে পারি। এজন্য প্রয়োজন যাতায়াত ব্যবস্থাাকে তাদের জন্য সহায়ক করে তৈরি করা। যেন তারা চার দেয়ালের বন্দী জীবন থেকে বেড়িয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এর মাধ্যমে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলার পাশাপাশি দক্ষতা প্রমাণের সুযোগ পায়। আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার, জাতীয় আইন, সংবিধানিক অধিকার সবখানেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জায়গা বাড়াতে সবাইকে আন্তরিক ও সচেষ্ট ভূমিকা রাখতে হবে, সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে, কর্পোরেটকে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর কল্যাণে এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিবন্ধী মানুষকে বাইরের জগতের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার মত সুখকর স্বপ্নকে সুন্দর অর্থবহ ও সার্থক করতে সবার সমন্বিত প্রয়াস দরকার যার মধ্য দিয়ে আমাদের বাংলাদেশ হয়ে উঠবে সত্যিকার অর্থে ভবিষ্যত প্রজন্মের নিরাপদ ঠিকানা।
মেজর জহিরুল ইসলাম
SCIDAB এর সহ সভাপতি এবং B-SCAN এর একনিষ্ঠ শুভাকাঙ্খী
No comments:
Post a Comment