১০০ মনীষীর
জীবনী
সম্রাট অশোক
(আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২৩২-৩০০)

প্রতিবেশী দুটি সাম্রাজ্য মগধ এবং কলিঙ্গ। মগধ অপেক্ষাকৃত বড়, তার শক্তিও তুলনায় বেশি। তবুও মগধ সম্রাটের মনে শান্তি নেই। প্রতিবেশী এক শত্রুকে রেখে কি নিশ্চিন্ত হওয়া যায়!
দুই পক্ষের সৈন্যবাহিনীই শক্তিশালী। কিন্তু মগধের সৈন্যরা অনেক বেশি যুদ্ধপটু আর কৌশলী। কলিঙ্গের সৈন্যরা বীর বীক্রমে লড়াই করেও পরাজিত হলো। আহত আর নিহত সৈন্যে ভরে উঠল যুদ্ধক্ষেত্র। রক্তাক্ত হলো সমস্ত প্রান্তর। কলিঙ্গরাজ নিহত হলেন।
বিজয়ী মগধ সম্রাট হাতির পিঠে চেপে যেতে যেতে দেখলেন তার দুপাশে ছড়িয়ে রয়েছে কত অসংখ্য মৃতদেহ। কত আহত সৈনিক। কেউ আর্তনাদ করছে, কেউ যন্ত্রণায় কাতর হয়ে চিৎকার করছে। কেউ সামান্য একটু পানির জন্য ছটফট করছে। আকাশে মাংসের লোভে শকুনের দল ভিড় করছে।
যুদ্ধক্ষেত্রের এই বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখে সম্রাট বিষণ্ন হয়ে গেলেন। অনুভব করলেন তার সমস্ত অন্তর ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে। ধীরে ধীরে নিজের তাঁবুতে ফিরে দেখলেন শিবিরের সামনে দিয়ে চলেছে এক তরুণ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী।
সন্ন্যাসী বললেন, আমি যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈনিকদের সেবা করতে চলেছি।
মুহূর্তে অনুতাপের আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল সম্রাটের হৃদয়। সম্রাটের অন্তরে জ্বলে উঠল নতুন এক প্রজ্ঞার আলোক। তিনি শপথ করলেন আর যুদ্ধ নয়, আর হিংসা নয়, ভগবান বুদ্ধের করুণায় আলোয় অহিংসা মন্ত্রে ভরিয়ে দিতে হবে সমগ্র পৃথিবী।
একদিন যিনি ছিলেন উন্মত্ত দানব-এবার হলেন শান্তি আর অহিংসার পূজারি প্রিয়দর্শী অশোক।
খ্রিষ্টপূর্ব ২৭২ সালে বিন্দুসারের মৃত্যুর পর পুত্রদের মধ্যে সিংহাসনের অধিকার নিয়ে বিবাদ শুরু হচ্ছিল। বিন্দুসারের জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম সুধীন, দ্বিতীয় পুত্র অশোক। সুধীন ছিলেন উদ্ধত বিলাসী। অশোক ছিলেন হৃদয়হীন নিষ্ঠুর প্রকৃতির। ভাইকে হত্যা করে সিংহাসন অধিকার করলেন। অশোকের পরের ভাইয়ের নাম ছিল তিষ্য। অশোক অনুভব করলেন তিনি জ্যেষ্ঠ ভাইকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেছেন, এতে রাজ্যের অনেকেই ক্ষুব্ধ। তার ওপর যদি তিষ্যকে হত্যা করেন প্রজারা বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারে। তাই তাকে পাঠিয়ে দিলেন তক্ষশীলায় সেখানকার শাসনকর্তা করে।
সর্বকনিষ্ঠ ভাইয়ের নাম ছিল বীতাশোক। ছেলেবেলা থেকেই বীতাশোক ছিলেন রাজ ঐশ্বর্য সুখভোগ বিষয়ে উদাসীন। সিংহাসনের এই অধিকার নিয়ে ভাইদের মধ্যের বিবাদ, হানাহানি তাকে আরও বিষণ্ন করে তুলল। সংসার ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন মুক্তির আশায়। বৌদ্ধ সন্ন্যাসী গিরিদত্তের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে বৌদ্ধসঙ্গে ভিক্ষু হয়ে গেলেন।
অশোক সিংহাসনে আরোহণ করে প্রথম কয়েক বছর নিজের অধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন। যারা তার আনুগত্য স্বীকার করতে অস্বীকার করল, তিনি তাদের নির্মমভাবে হত্যা করলেন। তার এই নৃশংসতার জন্য লোক তাকে চণ্ডাশোক বলত।
কলিঙ্গ যুদ্ধের অল্প কিছুদিন পরেই তিনি বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করলেন। বৌদ্ধ ধর্মের প্রেম করুণায় পূর্ণ হয়ে উঠল তার হৃদয়। চণ্ডাশোক অশোক রূপান্তরিত হলেন ধর্মাশোক অশোকে।
অশোক ঘোষণা করলেন আর যুদ্ধ নয়, এবার হবে ধর্ম বিজয়। ভ্রাতৃত্ব প্রেম, করুণার মধ্যে দিয়ে অপরকে জয় করতে হবে। শুধুমাত্র নির্দেশ প্রদান করেই নিজের কর্তব্য শেষ করলেন না। এত দিন যে রাজসুখ বিলাস ব্যসনের সাথে পরিচিত ছিলেন তা পরিত্যাগ করে সরল পবিত্র জীবনযাত্রা অবলম্বন করলেন।
তিনি সকল প্রতিবেশী দেশের রাজাদের কাছে দূত পাঠিয়ে ঘোষণা করেছিলেন তিনি তাদের সাথে মৈত্রী, প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চান। সকলে যেন নির্ভয়ে আপন রাজ্য শাসন করেন। এমনকি সম্রাট অশোক তার উত্তরাধিকারীদের কাছেও দেশ জয়ের জন্য যুদ্ধ করতে নিষেধ করেছিলেন। তিনি তাদের উপদেশ দিতেন অস্ত্রের মাধ্যমে নয়, প্রেম করুণা সহৃদয়তার মধ্যে দিয়েই মানুষকে জয় কর। এই জয়কে সম্রাট অশোক বলতেন ধর্ম বিজয়।
অশোক বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। প্রধানত তারই প্রচেষ্টায় পূর্ব ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসার লাভ করে। তবে তিনি ধর্ম প্রচারের জন্য শুধু যে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচারকদের পাঠাতেন তাই নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্তম্ভ পর্বত শিলাখণ্ডের ওপর বিভিন্ন উপদেশ উৎকীর্ণ করে দিতেন যাতে সেই অনুশাসন পাঠ করে প্রজারা তা পালন করতে পারে। অশোক এসব অনুশাসনে যে সমস্ত উপদেশ দিয়েছেন তার সাথে বৌদ্ধদের অষ্টমার্গের বিশেষ মিল নেই।
অশোকের নির্দেশে বহু পথ নির্মাণ করা হলো। এই সমস্ত পথের দুপাশে প্রধানত বট এবং আম গাছ পোঁতা হতো। যাতে মানুষ ছায়ায় পথ চলতে পারে। ক্ষুধার সময় গাছের ফল খেতে পারে। প্রতি আট ক্রোশ অন্তর পথের ধারে কূপ খনন করা হয়েছিল।
শুধু মানুষ নয়, পশুদের প্রতিও ছিল তার গভীর মমতা। তিনি সমস্ত রাজ্যে পশুহত্যা শিকার নিষিদ্ধ করেছিলেন। মানব সভ্যতার ইতিহাসে তিনিই প্রথম পশুদের জন্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেছিলেন। সর্বজীবের প্রতি করুণায় এমন দৃষ্টান্ত জগতে বিরল।
অশোক বৌদ্ধ হলেও অন্য কোনো ধর্মের প্রতি তার কোনো বিদ্বেষ ছিল না। সকলেই যে যার ধর্ম পালন করত। একটি শিলালিপিতে তিনি লিখেছেন, নিজের ধর্মের প্রতি প্রশংসা অন্যের ধর্মের নিন্দা করা উচিত নয়। পরস্পরের ধর্মমত শুনে তার সারবস্তু, মূল সত্যকে গ্রহণ করা উচিত।
ধর্মচরণে অধিক মনোযোগী হলেও রাজ্যশাসনের ব্যাপারে সামান্যতম দুর্বলতা দেখাননি। পিতা-পিতামহের মতো তিনিও ছিলেন সুদক্ষ প্রশাসক। সুবিশাল ছিল তার রাজ্যসীমা। তিনি শাসনকাজের ভার উপযুক্ত ব্যক্তিদের হাতেই দিতেন এবং প্রয়োজনমতো তাদের নির্দেশ দিতেন।
সম্রাট অশোক তার সমস্ত জীবন প্রজাদের সুখ কল্যাণে তাদের আত্মিক উন্নতির জন্য ব্যয় করেছিলেন। তবুও তার অন্তরে দ্বিধা ছিল। একজন সম্রাট হিসেবে তিনি কি তার যথার্থ কর্তব্য পালন করছেন? একদিন গুরুকে প্রশ্ন করলেন, গুরুদেব, সর্বশ্রেষ্ঠ দান কী?
বৌদ্ধ সন্ন্যাসী উত্তর দিলেন, সর্বশ্রেষ্ঠ দান ধর্মদান। একমাত্র ধর্মের পবিত্র আলোতেই মানুষের অন্তর আলোকিত হয়ে উঠতে পারে। তুমি সেই ধর্মদান কর।
গুরুর আদেশ নতমস্তকে গ্রহণ করলেন অশোক। তারই অনুপ্রেরণায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল বৌদ্ধ ধর্মের সুমহান বাণী। কিন্তু যেখানে বৌদ্ধ ধর্মের কোনো আলো গিয়ে পৌঁছায়নি, কে যাবে সেই দাক্ষিণাত্যের, সুদূর সিংহলে?
শুধু সিংহল নয়, ভারতবর্ষের বাইরে আরও বহু দেশে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য লোক পাঠালেন অশোক। তিনি চেয়েছিলেন তার অহিংসা ও প্রেমের বাণী হিন্দু বৌদ্ধ ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবে।
কিন্তু সেকালের ব্রাহ্মণরা তার এই বৌদ্ধ ধর্মপ্রীতিকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। উপরন্তু তার এক রানিও বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না। তিনি ব্রাহ্মণদের সাথে গোপন ষড়যন্ত্র করতে আরম্ভ করলেন। প্রথমে অশোক কোনো কিছুই জানতেন না। কিন্তু কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচর তার কাছে সমস্ত সংবাদ প্রকাশ করে দিল।
প্রচণ্ড মর্মাহত হলেন অশোক। যে আদর্শকে এত দিন তিনি লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে প্রচার করেছেন আজ নিজের স্ত্রী তার বিরোধিতা করছে। মনের দুঃখে রাজ্যপাট ত্যাগ করে বৌদ্ধবিহারে গিয়ে আশ্রয় নিলেন।
অশোকের অবর্তমানে তার সিংহাসনে বসলেন তার নাতি সম্পতি। তিনি বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি খুব একটা অনুরক্ত ছিলেন না। অশোকের আমলে ধর্মপ্রচারের জন্য প্রজাদের কল্যাণের জন্য যে অর্থ ব্যয় করা হতো, সম্পতি সেই ব্যয় কমিয়ে দিলেন।
একদিন যিনি ছিলেন সমগ্র ভারতের সম্রাট, আজ তিনি রিক্ত। বুঝতে পারলেন পৃথিবীতে তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে, এবার বিদায় নিতে হবে। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই বেদনাহত চিত্তে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন নৃপতি মহামতি অশোক।
Developed by

Friday, September 21, 2018
About ebongbd
"ALL ABOUT THINGS FOR EASY LIFE"
THIS IS A WEBSITE ABOUT SOLUTION OF OUR DAILY PROBLEMS. YOU CAN GET HERE ALL PROBLEM'S SOLUTION.
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment