প্রশ্নটা প্রায় সবার মধ্যেই কোনো না কোনো সময় জাগে। কিন্তু উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমাদের অনেক জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। কারণ মহাবিশ্বের জন্ম তো আর আমাদের মানবজন্মের মতো নয়। অনেক অনেক দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার আর অনেক জটিল। বিজ্ঞানীরা বলেন মহাবিশ্ব উৎপত্তি হয়েছে উচ্চ তাপমাত্রায় মিশ্রিত তরল ও ঘন আঠালো যুক্ত বিচিত্র ক্ষুদ্রকণার সমন্বয়ে। মহাবিশ্ব সৃষ্টির বিভিন্ন পর্যায়ে কয়েকটি ধাপের মধ্য দিয়ে বিস্তার লাভ করেছে। বর্তমানে আমরা যে মহাবিশ্ব দেখতে পাই তার বয়স প্রায় ১৩শ কোটি বছরের উপরে। মহাবিশ্বের শুরুটা বিগব্যাং থেকে, এবং সেখান থেকে সময় আর শূণ্যের সৃষ্টি এবং ধীরে ধীরে মহাশূণ্যের বিস্তৃতি ঘটেছে।
চিররহস্য ঘেরা এই মহাজগতটি সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের বিগব্যাং তত্ত্বের জনক,বেলজিয়ান জ্যোতির্বিদ জর্জ লুমিত্রু–যুগে ফিরে যেতে হবে। ১৮২৭ সালে তিনি আইনস্টাইনের একটি সমীকরণ সমাধান করতে গিয়ে ধারণা করেন সময় সৃষ্টির শুরুতে একটা বিন্দু থেকে স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছ। স্ফুলিঙ্গ যেমন অধোমুখী হয়ে লাল কুন্ডলী,ভষ্ম এবং ধোঁয়া পাকিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পরে তেমনি মহাবিশ্বও সেইসময় দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। লুমিত্রু ওইসময় একজন শিক্ষানবীশ জ্যোর্তিবিদ ছিলেন। মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে তাঁর এই অনুসন্ধানকার্যক্রম বেলজিয়ামেরই এক অখ্যাত বিজ্ঞান জার্নালে প্রকাশিত হয়। ফলে তৎকালীন হাতেগোণা কয়েকজন বিজ্ঞানী ছাড়া আর কারও এই বিষয়টি নজরে আসেনি।
ওইসময় যুক্তরাষ্ট্রের একজন জোতির্বিদ মহাবিশ্ব নিয়ে উৎসাহী হয়ে অনেক তথ্য যোগাড় করেন। তাঁর এই তথ্যগুলি লুমিত্রুর তথ্যের সাথে বেশ মিলে যায়।এদিকে বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল এবং তাঁর তার সহযোগী মিল্টন হুমাসন ক্যার্লিফোনিয়ার মাউন্ট উইলসন পর্যবেক্ষণকেন্দ্র থেকে ২.৫ মিটার লম্বা টেলিস্কোপের সাহায্যে কুণ্ডলীপাঁকানো নেবুলা (গ্যালাক্সি) নিয়ে গবেষনায় ব্যাস্ত থাকতেন। পূর্বে ধারণা ছিল এই কুণ্ডলীপাঁকানো নেবুলা বোধহয় আমাদের আকাশগঙ্গা গ্যালাক্সিরই অংশ কিন্তু হাবলের অনুসন্ধান থেকে জানা যায়,আসলে তা নয়। কুণ্ডুলীপাঁকানো নেবুলার আলাদা মহাবিশ্ব রয়েছে,এবং এদের মধ্যেকার দূরত্ব আকাশগঙ্গা থেকে কোটি কোটি আলোকবর্ষ।নেবুলার রেডশিফট হিসাব করে এডুইন হাবল এই বিষয়টি আবিষ্কার করেন। রেডশিফট বিষয়টা অনেকটা এরকম,কোনো অ্যাম্বুলেন্স বা পুলিশভ্যান যখন উচ্চশব্দের সাইরেন বাজিয়ে আমাদের দিকে আসতে থাকে তখন ডপলার ইফ্যাক্টের কারণে শব্দতরঙ্গগুলি একত্রে জড়ো হয় তীব্র আওয়াজের সৃষ্টি করে। কিন্তু পুলিশভ্যান বা অ্যাম্বুলেন্স যখন আমাদের অতিক্রম করে চলে যায় তখন শব্দতরঙ্গগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে থাকে এবং সাইরেনের তীব্রতাও কমতে থাকে আমাদের কাছ থেকে। মহাশুন্যে আমাদের দিকে ধাবমান বস্তুর তরঙ্গদৈর্ঘের আলোকরেখাগুলো সংকুচিত হয়ে নীল রঙের আলোক তরঙ্গদৈর্ঘ্য সৃষ্টি করে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছে ব্লুসিফট (Blue shift)।আর যখন বস্তুগুলো তীব্রবেগে আমাদের বিপরীত থেকে চলে যায় তখন লাল আলোক তরঙ্গদৈর্ঘ্যর সৃষ্টি করে। একে বলে রেডসিফট।
এডুইন হাবল মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করে আবিষ্কার করলেন প্রায় প্রতিটি গ্যালাক্সির রেডসিফট রয়েছে। এর মানে হচ্ছে মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিগুলো আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে বা অনবরত প্রসারিত হয়ে চলছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানে হাবলের এই আবিষ্কারকে অসাধারণ গুরুত্বের সাথে দেখা হয়,একে “হাবল ল” হিসেবে অভিহিত করা হয়।হাবলের এই আবিষ্কার থেকে প্রশ্ন দেখা দেয়,গ্যালাক্সিগুলো যদি এভাবে একে অপর থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যায়, তাহলে কোনো একসময় কি এরা খুব ঘনিষ্ট ছিল, মানে একত্রীভূত ছিল পরবর্তীতে কোনো মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছে?–প্রশ্নটা বিজ্ঞানীদের নতুন চিন্তার খোরাক যোগায়।
১৯৩১ সালে ব্রিটিশ জ্যোতিঃপদার্থবিদ স্যার আর্থার অ্যাডিংটন লুমিত্রুর গবেষণাগুলো উদ্ধারের পর বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে উঠেন। মজার বিষয় হচ্ছে,ততদিনে এডউইন হাবলও আবিষ্কারের মঞ্চে চলে এসেছেন। তবে জ্যোতির্বিজ্ঞানের জগতে লুমিত্রুের উত্থান এতো সহজে হয় নি। আইনস্টাইনের মতো অনেক বিজ্ঞানীও পর্যন্ত লুমিত্রুের আবিষ্কারকে সন্দেহের চোখে দেখেন। কিন্তু হাবল যখন তথ্য-উপাত্ত হাজির করেন তখন বিজ্ঞানীদের সস্দেহ দূরীভূত হয়।এদিকে হাবলের মহাবিশ্বের প্রসারমানতা নিয়ে আবিষ্কার যখন ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়,তখন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিদ ফ্রেড হয়েল এর ব্যাপক সমালোচনা করেন। “মহাবিশ্বের প্রসারমানতা”কে তিনি “মহাবিস্ফোরণ” বলে অভিহিত করেন। মানে তিনি উপহাস করে “বিগব্যাং” শব্দটি প্রদান করেছিলেন। অথচ ফ্রেড হয়েলের এই উপহাসের নামটিই জ্যোতির্বিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ফ্রেড হয়েল অবশ্য শুধু বিগব্যাং বলে ঠাট্টাই করেননি,তিনি নিজে মহাবিশ্বের উদ্ভব নিয়ে একটা মডেল দাঁড় করান। তার মতে মহাবিশ্ব হলো চিরস্থায়ী একটা জগত,এর জন্ম,মৃত্য,শুরু–শেষ বলে কিছু নেই। হয়েলের মহাবিশ্বের মডেলটাকে বিজ্ঞানীরা গ্রহণ করেননি। এটি এখন পরিত্যক্ত। বরং একথা সবারই জানা বিগব্যাং তত্ত্বই এখন পর্যন্ত মহাবিশ্বের উদ্ভব নিয়ে বিজ্ঞানীদের কাছে গ্রহণযোগ্য। তবে এটাও ঠিক বিজ্ঞানীদের কাছে এখন পর্যন্ত অনেক প্রশ্নের উত্তর অমীমাংসিত রয়ে গেছে।মহাবিশ্বের একদম শুরুর দিকের আদিম অবস্থা থেকে বর্তমানের কালের মহাবিশ্বের অবস্থা নিয়ে বিজ্ঞানীরা হয়তো পুরো চিত্র দাঁড় করাতে পারেননি। এই ধরেনর বিশাল গবেষণাযজ্ঞের জন্য প্রয়োজন প্রচুর তত্ত্ব-উপাত্ত আর বিশাল অঙ্কের অর্থ।
যে কোনো ধরনের বস্তুগত এবং উপাত্ত সংগ্রহ হলে সেগুলোর গাণিতিক মডেল দাঁড় করান বিজ্ঞানীরা। এবং এখন পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে বিগব্যাঙ মডেল মহাবিশ্বের উদ্ভব নিয়ে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য। তবে আরো ব্যাপক গবেষণা কার্যক্রম চালানোর বিজ্ঞানীরা এখন ব্যস্ত Cosmic Microwave Background সংক্ষেপে CMB নিয়ে। CMB একটি মহাকর্ষীয় তরঙ্গ যা অনেক গ্যালাক্সির মধ্যে সর্পিলাকারে উপস্থিত রয়েছে।
মহাজাগতিক দেহাবশেষ
Digital-Universe মহাবিশ্বের প্রতি মুহূর্তের গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে আমরা এর অতীত সম্পর্কে জানতে পারি। ১৯৬৫ সালে জ্যোতির্বিদ আরনো পেঞ্জিয়াস ও রবার্ট উইলসন বেল ল্যাবরেটরিতে গবেষণার সময় CMB এর উপস্থিতি ধরা পড়ে। তারা হলমডেন হর্ন এন্টেনা নামের এক ধরনের রেডিও টেলিস্কোপ ডিভাইস নিয়ে কাজ করার সময় শব্দ পান। এই শব্দ টিভি স্ক্রিনে নেটওয়ার্ক না থাকলে যেমন ঝিরঝির বা হিসহিস করে তেমনি নিম্ন মাত্রার বৈদ্যুতিক গোলযোগের মত ছিল। সম্ভাব্য সব ধরনের আনুষাঙ্গিক পরীক্ষা চালিয়ে নিশ্চিত হন, মহাশূন্য থেকে তারা বিশেষ এক ধরনের সংকেত পাচ্ছেন যা তারা ব্যাখ্যা করা পারছিলেন না। ধারণা করা হলো এই ব্যাখ্যাতীত সংকেতটি সম্ভবত মহাশূন্যের সবদিক থেকে আসছে। বিজ্ঞানীরা ভাবতে লাগলেন সংকেতগুলো বোধহয় মহাজাগতিক তরঙ্গের ফলে সৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু এই মহাজাগতিক তরঙ্গের অস্তিত্ব আদতে রয়েছে কিনা সে সম্পর্কে তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন না। যদি আমাদের এই মহাবিশ্বের শুরু থাকে তাহলে এই শুুরুর দিককার অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ কুণ্ডুলীর কিছু রেশ এখনো থেকে যাওয়ার কথা। যাকে আমরা বলতে পারি মহাজাগতিক তরঙ্গের “দেহাবশেষ”। এবং এগুলো বোধহয় পরম শূন্য তাপমাত্রার (-২৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস প্রায়) চেয়ে মাত্র ২.৭ ডিগ্রি উপরে অবস্থান করছে। মহাবিশ্বের শুরুর দিকে প্রচণ্ড উত্তপ্ত ছিল কিন্তু এর প্রসারমানতার ফলে এই উত্তপ্ত অবস্থা ক্রমে হ্রাস পেয়ে মহাবিশ্বের বিশাল এলাকাটিকে শীতল স্থানে পরিণত করেছে আর তরঙ্গগুলো মহাবিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে।
মহাবিশ্বের মহাবিস্ফোরণ (বিগ ব্যাঙ) সংঘটিত হওয়ার প্রায় ৩ লক্ষ ৮০ হাজার বছর পরে যখন মহাবিশ্বের তাপমাত্রা প্রায় ৩০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে নামে তখন এই মহাজাগতিক তরঙ্গ নির্গত হতে শুরু করে। মহাবিশ্বের তখনকার এই তাপমাত্রা মহাবিশ্বের সকল ছুটন্ত মুক্ত ইলেকট্রনকে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে একত্রীভূত করতে পারে। আলোক ও রেডিয়েশনের পথ থেকে যেসব ইলেকট্রন বেরিয়ে আসে তারা কোনো অন্যান্য ইলেকট্রনের সাথে বাধার সম্মুখীন না হয়ে মুক্তভাবে মহাশূন্যে চলাচল করতে পারে এবং আলোর সৃষ্ট করে। আর আমরা মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েব ব্যাকগ্রাউন্ড (সিএমবি)-এর সাক্ষাৎ পাই। যদিও সিএমবি‘র এই উপস্থিতি থেকে মহাবিশ্বের একদম শুরুর মুহূর্তে আসলে কি ঘটেছিল সে সম্পর্কে কিছু জানা যায় না,তবে ক্ষণিকের মধ্যে আলোর গতির চেয়েও বেশি গতিতে মহাবিশ্বের বিস্তৃতি থেকে আমরা অনুমান করতে পারি বিগ ব্যাঙের পরে আসলে কী ঘটেছিল।
মহাকাশের মানচিত্রায়ন
পেঞ্জিয়াস ও উইলসন তাদের কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু মহাজাগতিক অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ সম্পর্কে জানার তখনো অনেক বাকি ছিল। এজন্য মহাবিশ্বের জন্য একটি মানচিত্র তৈরির প্রয়োজন। ১৯৮৯ সালে নাসা প্রথমে এ ব্যাপারে উদোগ্য নেয়। সংস্থাটির মালিকানাধীন মহাকাশযান Cosmic Background Explorer (COBE)-এর সাহায্যে সিএমবি‘র বিভিন্ন চিত্রধারণ করা শুরু করে। চার বছরের চেষ্টায় তারা সিএমভি-এর অন্তর্গত এমন সব উত্তপ্ত ও শীতল স্থানগুলোর মানচিত্রটি তৈরি করতে সক্ষম হয়, যেগুলো মহাবিশ্বের শুরুর দিককার মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র যা পরবর্তীতে লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ সমান প্রসারিত গ্যালাক্সিপুঞ্জে তৈরি হয়েছিল। COBE-এর প্রধান বিজ্ঞানী জর্জ স্মুট গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার পান কিন্তু COBE-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার ফল এসেছিল Wilkinson Microwave Anisotropy Probe (WMAP)-এর গবেষণা থেকে। WMAP আরো উন্নত রেজ্যুলেশনের চিত্রধারণ করতে সক্ষম হয়। সেখানে অতিক্ষুদ্র রেডিয়েশনের তাপমাত্রা ২৫ মিলিয়ন ডিগ্রি পর্যন্ত ভিন্নতাকে চিহ্নিত করে মহাবিশ্বের পুরো আকাশের মানচিত্র তৈরির করার জন্য তারা কাজ করেছে। মহাবিশ্বের আকৃতি সম্পর্কে WMAP-এর জ্যোতির্বিদদের মতামত হচ্ছে এটি সমতল, কেননা এক ডিগ্রির মধ্যে বিস্ফোরণের চিত্রগুলো উজ্জ্বল ও গাঢ়ভাবে প্রতীয়মাণ হয়েছে। ২০১০ সালে WMAP তাদের শেষ অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ নিয়ে কাজ করে নয় বছেরর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ অভিযানের সমাপ্তি টানে। এই অভিযান থেকে তারা এমন একটি শক্ত ভিত তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে যাতে ভবিষ্যতে আরোও গবেষণার পথ উন্মুক্ত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ESA’s Planck নামে নতুন মহাবিশ্ব গবেষণাকেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। গবেষণাকেন্দ্রটি আদি-মহাবিশ্বের ধারণার নিয়ে কাজ করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জ্যোতির্বিদরা বিভিন্ন মাত্রার মাইক্রোওয়েভ ও ইনফ্রারেড ফ্রিকোয়েন্সি নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন। মহাকাশযানের সাহায্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহের জন্য এর সাথে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ যুক্ত করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা আশানুরুপভাবে মহাবিশ্বের ভিতর থেকে প্রায় নির্ভুল তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন। ESA’s Planck থেকেও বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্ব থেকে সিএমভি সম্পর্কে আরো বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেন। গত বছর অক্টোবরে এই অভিযান শেষ হবার কথা ছিল কিন্তু এর মধ্যেই বিজ্ঞানীরা প্রায় নির্ভুল ভাবে মহাবিশ্ব এবং এর শুরু দিকের আরো উন্নতমানের চিত্র আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। এবং এর মধ্যে আরো একটি সত্য বিজ্ঞানীরা অনুধাবন করতে পেরেছেন যে মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্যভেদ করার জন্য মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডই এক মাত্র উৎস নয়।
মহাকর্ষীয় তরঙ্গের মধ্যে যে আরেক ধরনের ক্ষুদ্র তরঙ্গ রয়েছে সেগুলো হচ্ছে সেই ঐচ্ছিক উৎস। এই অস্থির ক্ষুদ্র তরঙ্গ গুলো হচ্ছে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব থেকে বাদ পড়া অন্যতম অংশ। সব ধরনের প্রকাণ্ড বস্তু দ্বারা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সৃষ্টি করা যেতে পারে। কিন্তু কোন কোন বিজ্ঞানী মনে করেন বিগ ব্যাংয়ের মধ্যে এই তরঙ্গ সৃষ্টি হয়েছে এবং মহাবিশ্বে আজও ও একই রকম তরঙ্গায়িতভাবে রয়েছে। সমস্যা হচ্ছে এই ধরনের তরঙ্গগুলোর অস্থির চরিত্রের কারণে সহজে প্রত্যক্ষভাবে সনাক্ত করা যায় না। মহাকাশে এই তরঙ্গগুলো অনিয়ন্ত্রিত। তবে এটা সুখের বিষয় যে বিগ ব্যাংগের সময় থেকে এই তরঙ্গ এখনো আমাদের কাছে অবিকৃতভাবেই এসেছে। তাদেরকে সনাক্ত করার জন্য অবিশ্বাস্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সেন্সেটিভ ডিটেক্টর প্রয়োজন। বিজ্ঞানীরা কোন রাখঢাক ছাড়াই বলেছেন যে এই বিশেষ তরঙ্গগুলো বশে আনার অভিপ্রায় তাদের রয়েছে। বিশাল আকৃতির ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বরের আবির্ভাবের মত বড় ধরনের ঘটনার কারনে সৃষ্ট মহাকর্ষীয় তরঙ্গগুলোকে পরিচিত ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশনের মাধ্যমে সনাক্ত করা যায়। সেগুলো যে কোন ধরনের গঠনের হোক – গ্যাসীয় অথবা ধূলিকণা, এই রেডিয়েশনের মাধ্যমেই এদের সম্পর্কে তথ্য জানা যেত। কিন্ত এই বিশেষ রকমের পলায়নরত তরঙ্গগুলোকে ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন দিয়ে সনাক্ত করা সম্ভব নয়।
আবিষ্কারের চেষ্টা
Laser Interferrmeter Gravitational Observatory - Wave সংক্ষেপে LIGO ব্যাপক গবেষণা চালিয়েছে এই ক্ষীণ তরঙ্গ বা পলায়ন প্রকৃতির তরঙ্গ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য। প্রথমে এই তরঙ্গকে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এ কাজে এখন পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ আমাদের কাছে এখনো উন্নত প্রযুক্তির অভাব রয়েছে। বিজ্ঞানীর 2 December 2015 তারিখে LISA Pathfinder নামে একটি মিশন লাঞ্চ করে। যা পৃথিবীর পরিমণ্ডলের বাইরে গিয়ে মহাবিশ্বের ঘনস্থান বরাবর কাজ করছে। এটি এমন একটি অভিযান যার মাধ্যমে এই অস্থির প্রকৃতির তরঙ্গগুলো বিজ্ঞানীদের নজরে আসবার পন্থা সম্বন্ধে ধারণা দিবে । বিজ্ঞানীরা তাদের এই অভিযানে evolved Laser Interferometer Space Antenna বা eLISA – এর সহায়তা নিয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা “অস্থির পলায়নরত” তরঙ্গগুলোকে সরাসরি সনাক্ত করতে সক্ষম হয় নাই । ভবিষ্যতে এই তরঙ্গ আবিষ্কারের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা কিভাবে গ্যালাক্সি সৃষ্টি হয়েছিল, কিভাবে নক্ষত্রগুলো বৃদ্ধি পেল এবং প্রারম্ভিক মহাবিশ্ব সম্পর্কে আরো অনেক অজানা তথ্য জানতে পারবেন শুধু এতেই শেষ নয়, Space-Time এর গঠন ও প্রকৃতি সম্পর্কে আরো অনেক বেশী তথ্য জানাতে পারবেন। এমনকি ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর এবং অন্যান্য অজানা বিষয় সম্পর্কে জানার দ্বার উন্মুক্ত হবে। LISA Pathfindere দিয়ে আবিস্কার কৃত পন্থা দিয়ে eLISA নামের আরো একটি অতিউন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন মহকাশ যানের সূচনা করবে ২০৩০ এ। আশা করা হচ্ছে eLISA “অস্থির পলায়নরত” তরঙ্গগুলোকে সরাসরি সনাক্ত করতে সক্ষম হবে।
দলগত ভাবে এবং বিভিন্ন ত্তত্ব থেকে অজস্র সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তগুলোকে একত্র করে এক বিশাল আকারের ছবি অ্যালবাম অথবা মহাবিশ্বের জন্ম থেকে শুরু করে ১৩.৮ বিলিয়ন বছরের একটি সুন্দর টাইমলাইন তৈরি করা যায়। এখান থেকে প্রতীয়মান হয় যে সেখানে প্লাজমা স্যুপের জন্য কিছুই নেই। মহাবিশ্ব ছিল ম্যাটার এবং অ্যানিম্যাটার এই উভয় কণাসহ অবিশ্বাস্য রকমের উত্তপ্ত। এখানে অ্যান্টিম্যাটারগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল। পরে ধীরে ধীরে মহাবিশ্ব ঠাণ্ডা হতে শুরু করে এবং সমান সংখ্যক ম্যাটার ও অ্যানিম্যাটার তৈরি করে। এই ম্যাটার এবং অ্যান্টিম্যাটারগুলো দ্রুত পরস্পরকে ধবংস করতে শুরু করে। সৌভাগ্যক্রমে কিছু ম্যাটার ধবংসের হাত থেকে বেঁচে যায়। কিভাবে তারা বেঁচে যায় তা এখনো অজানা। যখন মহাবিশ্ব ধীরে ধীরে নিঃশেষিত হয়ে এবং আরো ঠান্ডা হতে শুরু করে তখন এই বেঁচে যাওয়া অতিরিক্ত ম্যাটারেরে অণুগুলো জড়ো হয়ে কতগুলো ব্লক তৈরী করে। এভাবেই ধীরে ধীরে তারা একটি আকৃতি গঠন করতে শুরু করে। বিগ ব্যাংগের প্রায় ৪০০ মিলিয়ন বছর পরে প্রথম নক্ষত্রটি গঠিত হয়। এভাবে ধীরে ধীরে প্রথম গ্যালাক্সি গঠিত হয়। সবচেয়ে পুরাতন গ্যালাক্সিটি আনুমানিক ১৩.২ বিলিয়ন বছরের পুরাতন। বিগ ব্যাং সংঘটিত হয়েছিল এই ব্যাপারে সমস্ত বিজ্ঞানীরাই এক মত। কিন্তু তারপরেও মহাবিশ্বের বৃদ্ধি সম্পর্কৃত অনেক প্রশ্নই অজানা রয়ে গেছে। যেমন মহাবিশ্ব কোথা থেকে এলো? কেন প্রথমে এটার আবির্ভাব হয়েছিল? প্রারম্ভিক মহাবিশ্বে কেন ম্যাটারের চেয়ে অ্যানিম্যাটারের সংখ্যা বেশি ছিল? কেন ডার্ক এনার্জির কারণে মহাবিশ্বের বিস্তৃতি দ্রুততর হয়েছিল?
আসলে প্রকৃত ব্যাপারটি হচ্ছে বিগ ব্যাংয়ের বিস্ফোরণ কোন কিছু থেকে হয়নি। এটি সব জায়গা থেকেই সংঘটিত হয়েছিল। সেই কারণেই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে সবর্ত্র CMB রয়েছে। মহাবিশ্বের চূড়ান্তরূপ কি হবে, এটি কি ধবংস হয়ে যাবে নাকি চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে–এসব নির্ভর করছে মহাকাশে এই মহাবিশ্ব মহাজাগতিক যুদ্ধ জয় করতে পারবে, নাকি মাধ্যাকর্ষণ শক্তির হেঁচকা টানে মহাবিশ্বকে নামিয়ে আনবে, নাকি ডার্ক এনার্জির কারণে এই মহাবিশ্ব বিস্তৃতি বৃদ্ধি পেতেই থাকবে তার উপর।
No comments:
Post a Comment