আমাদের সবাই জীববিজ্ঞানে উচ্চতর শিক্ষা না নিলেও ‘জীন’ শব্দটার সাথে আমাদের জেনারেশন কমবেশি পরিচিত। ‘জেনেটিক কোডের মাধ্যমেই জীবদেহের সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয়’-এরকম ধারণাও সবাই কমবেশি রাখেন। তবে জেনেটিক কোড কি এবং এটা কিভাবে কাজ করে, এটা সবার কাছে পরিষ্কার নয়, এবং পরিষ্কার হবার কথাও নয়। আমার উদ্দেশ্য জেনেটিক কোড কিভাবে কাজ করে সেটা ব্যাখ্যা করা, এবং এর সাথে এই কোড আবিষ্কারের ইতিহাস ব্যাখ্যা করা।
জেনেটিক কোডের ধারণাটা মোটামুটি জটিল। জটিল হবার কারণ হলো, এই কোডের ধারণা বোঝার আগে অনুপ্রাণ বিজ্ঞানের (মলিকুলার বায়োলজি) আরও কিছু মৌলিক ধারণা রাখতে হয়। তবে পদার্থবিদ ফাইনম্যান একটা কথা বলেছিলেন, ‘তুমি যদি বিজ্ঞানের একটা ধারণা অন্য কাউকে সহজে বোঝাতে না পার, ধরে নাও তুমি নিজেও সেটা বোঝোনি’। সঠিকভাবে জেনেটিক কোডের কার্যরীতি এবং ( ল্যাব এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে ) এর আবিষ্কারের ইতিহাস ব্যাখ্যা করা আমার নিজের ধারণার স্বচ্ছতার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। ফাইনম্যানের উক্তিটি মাথায় রেখেই আমি চ্যালেঞ্জটি নিচ্ছি। যদিও ধারণা অনেক বেশি সংক্ষেপিত, সরলীকৃত, এবং কিছু মাত্রায় অসম্পূর্ণ, আমি আশা করছি যে জেনেটিক কোড এর মূল নির্যাসটা আমি এখানে তুলে ধরতে পারব।
জেনেটিক কোড বোঝার আগে আমাদের যে প্রাথমিক ধারণাগুলো বুঝতে হবে সেগুলো হলোঃ
১। ডিএনএ
২। জীন
৩। ডিএনএ এবং জীন এর পার্থক্য
৪। আরএনএ
৫। এম আরএনএ
৬। টি আরএনএ
৭। প্রোটিন
৮। অনুপ্রাণ বিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় তত্ত্ব ( সেন্ট্রাল ডগমা অব মলিকুলার বায়োলজি)
আসুন শুরু করা যাক।
ডিএনএঃ ডিএনএ হলো কোষের মূল তথ্যকেন্দ্র। ডিএনএ চারটি ম্যাক্রোমলিকিউল বা বৃহদাকার অণু দিয়ে গঠিত। এই চারটি ‘বৃহৎ অণু’ হলোঃ অ্যাডেনিন (A), থাইমিন (T), গুয়ানিন (G), সাইটোসিন (C)।
জীনঃ জীন হলো ডিএনএ এর কার্যকরী একক। ডিএনএ এ এর যে অংশ তথ্য সংরক্ষণ করে থাকে তাকে জীন বলে।
ডিএনএ এবং জীন এর পার্থক্যঃ এখানে একটা রূপক দিয়ে বোঝালে ভালো হবে। ধরা যাক, একটা কম্পিউটারের যাবতীয় তথ্য সংরক্ষিত থাকে তার হার্ডডিস্কের ভেতর। তবে কম্পিউটারে হার্ডডিস্ক বাদেও মাদারবোর্ড, প্রসেসর, র্যাম, কেসিং, মনিটরসহ অন্যান্য অংশ থাকে। পুরো কম্পিউটার যদি ডিএনএ হয়, তাহলে এর হার্ডডিস্ক হলো জীনের সমতুল্য।
ডিএনএ এর পুরো অংশই জীন নয়। মানুষের পুরো ডিএনএ তে জীন এর পরিমাণ শতকরা ২ শতাংশেরও কম।
এই রূপকের একটা সীমাবদ্ধতা হলো, কম্পিউটারের সব অংশের গাঠনিক একক এক নয়। অন্যদিকে, ডিএনএ এবং জীন, উভয়ের গাঠনিক এককই হলো সেই চার অক্ষর, A,T,G,C। ডিএনএ এর একটা বড় অংশ কোন তথ্য সংরক্ষণ করে না, এবং যে অংশগুলো তথ্য সংরক্ষণ করে আমরা তাদের জীন বলি। মানুষের ডিএনএ তে জীন এর পরিমাণ শতকরা ২ ভাগেরও কম, ১.৫ ভাগের মতো (সাইটেশন ১)।
আরএনএ(RNA): ডিএনএ এর মতোই আরএনএ এর গাঠনিক একক চারটি অক্ষর, যার মধ্যে তিনটি অক্ষর ডিএনএ এর সাথে মিলে যায়। আরএনএ এর চারটি একক হলোঃ অ্যাডেনিন (A), ইউরাসিল (U), গুয়ানিন (G), সাইটোসিন (C)-A,U,G,C। ডিএনএ এবং আরএনএ এর এই গাঠনিক এককগুলোকে সাধারণভাবে বলা হয় নিউক্লিওটাইড বেস ( যদিও এদের আরও বিশেষায়িত নাম আছে, আমি আলোচনা সরল রাখার সুবিধার্থে আপাতত সেদিকে যাচ্ছি না )।
আরএনএ মূলত তিন প্রকার, তবে আমি এখানে দুই প্রকার আরএনএ নিয়ে আলোচনা করব।
এমআরএনএ(mRNA): এমআরএনএ হলো ‘মেসেঞ্জার আরএনএ’ বা বার্তাবাহক আরএনএ। ডিএনএ তে জীনের তথ্য সংরক্ষিত থাকে ঠিকই, তবে যখন যেখানে এই তথ্য প্রয়োজন এই তথ্য সরবরাহ করে এমআরএনএ। ডিএনএ এজন্য মূল তথ্যকেন্দ্র হলেও এমআরএনএ হলো মূল বার্তাবাহক।
আপনার শরীরে নিউরন কোষ আছে, লিভারের কোষও আছে। যদিও ডিএনএ এর তথ্য দেহের সব কোষে একই, একটা নিউরন কোষের জন্য যে তথ্যর দরকার হয়, একটা লিভারের কোষের জন্য সেই একই তথ্যর দরকার হয় না। প্রয়োজনমত এই তথ্যর সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে এমআরএনএ।
প্রোটিনঃ প্রোটিন হলো জীবকোষের কর্মীবাহিনী। ডিএনএ তথ্য সংরক্ষণ করে, এমআরএনএ তথ্য সরবরাহ করে, এবং তথ্য অনুসারে পৃথিবীর সকল জীবকোষে সকল কার্য সম্পাদন করে প্রোটিন। আপনার দেখা, শোনা, খাওয়া, ঘুমানো এবং যাবতীয় জৈবিক কাজকর্ম প্রোটিনের নিয়ন্ত্রণে। জীবদেহে অনেক রকম বিশেষায়িত কাজ করতে হয়, এবং সেজন্য জীবদেহে প্রোটিনের সংখ্যা আক্ষরিক অর্থেই লক্ষ লক্ষ।
প্রোটিনের গাঠনিক একক হলো অ্যামিনো এসিড। জীবদেহে মূলত ২০ ধরনের অ্যামিনো এসিড পাওয়া যায়।
পলিপেপটাইডঃ
প্রোটিনের অসম্পূর্ণ ক্ষুদ্র অংশকে পলিপেপটাইড বলে। সুতরাং, পলিপেপটাইডের গাঠনিক এককও হলো অ্যামিনো এসিড।
অনুপ্রাণ বিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় তত্ত্ব ( সেন্ট্রাল ডগমা অব মলিকুলার বায়োলজি):
১৯৫৮ সালে ফ্রান্সিস ক্রিক সর্বপ্রথম এই তত্ত্ব বিবৃত করেন (সাইটেশন ২)। এক কথায় এই তত্ত্ব বলে, জীবদেহের কোষে তথ্যপ্রবাহ সবসময় একমুখী। ডিএনএ থেকে তথ্য এমআরএনএ তে প্রবাহিত হবে, এমআরএনএ থেকে প্রোটিনে প্রবাহিত হবে।
সেন্ট্রাল ডগমা অব মলিকুলার বায়োলজিঃ
১। ডিএনএ থেকে আরএনএ হয়( ট্রান্সক্রিপশন)
২। আরএনএ থেকে প্রোটিন হয় ( ট্রান্সলেশন)
ডিএনএ থেকে এমআরএনএ তে তথ্য প্রবাহিত হবার প্রক্রিয়াকে বলা হয় ট্রান্সক্রিপশন, বা ‘নকল করা’। কারণ, আরএনএ এবং ডিএনএ এর গাঠনিক একক মূলত এক(কেবল একটি অক্ষর বাদে), এবং এমআরএনএ মূলত ডিএনএ এর তথ্য হুবহু কপি করে ‘ট্রান্সক্রিপ্ট’ তৈরি করে। অন্যদিকে, এমআরএনএ থেকে প্রোটিন তৈরি হবার প্রক্রিয়াকে বলা হয় ট্রান্সলেশন বা অনুবাদ। কারণ, এমআরএনএ আর প্রোটিনের গাঠনিক একক ভিন্ন, এবং প্রোটিন তৈরি করার সময় এমআরএনএ এর এই ‘কোড’ অনুবাদিত হয় বিভিন্ন প্রোটিনে। প্রোটিন সংশ্লেষণের এই কাজ সম্পন্ন হয় কোষের রাইবোজম নামক অঙ্গাণুতে।
মূলত, এমআরএনএ এর এই কোডই হলো ‘জেনেটিক কোড’।
টিআরএনএঃ এমআরএনএ এর জেনেটিক কোডকে ‘রিড’ করে এবং প্রোটিনে অনুবাদ করে আরেক ধরনের আরএনএ, টিআরএনএ। এমআরএনএ তে যে সংকেত থাকে, সে অনুযায়ী অ্যামিনো এসিড নিয়ে আসে টিআরএনএ। পাশাপাশি অনেকগুলো অ্যামিনো এসিড সংযুক্ত হয়ে তৈরি হয় প্রোটিন।
ফ্রান্সিস ক্রিক সর্বপ্রথম এমআরএনএ এর সাথে প্রোটিনকে সংযুক্ত করার জন্য এই মধ্যবর্তী অ্যাডাপ্টরের হাইপোথিসিস দেন, যার এক প্রান্ত এমআরএনএ এর সাথে এবং আরেক প্রান্ত এমিনো এসিডের(প্রোটিনের গাঠনিক একক) সাথে সংযুক্ত থাকবে। তার এই হাইপোথিসিস পরবর্তীতে সঠিক প্রমাণিত হয়, এবং এই মধ্যবর্তী অ্যাডাপ্টর হিসেবে টিআরএনএ এর ভূমিকা আবিষ্কৃত হয়।
ফ্রান্সিস ক্রিকের ‘অ্যাডাপ্টার’ হাইপোথিসিস, যা পরবর্তীতে সঠিক প্রমাণিত হয়।
টিআরএনএ, এমআরএনএ তে বর্ণিত নির্দিষ্ট কোডের উপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট অ্যামিনো এসিড নিয়ে আসে।
জেনেটিক কোডের ইতিহাসঃ
সঠিকভাবে তথ্যপ্রবাহের জন্য জীবদেহে জেনেটিক কোড থাকতে পারে, সর্বপ্রথম এরকম ইঙ্গিত দেন একজন । এরুইন শ্রোডিঞ্জার ১৯৪৩ সালে ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজে তার ‘What is life’ শীর্ষক লেকচারে সর্বপ্রথম জেনেটিক কোড এর সম্ভাবনার কথা বলেন।
শ্রোডিঞ্জার সর্বপ্রথম ‘জেনেটিক কোড’ এর আভাস দেন।
শ্রোডিঞ্জারের সময় জীববিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল ডিএনএ নয়, প্রোটিন হলো জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল। শ্রোডিঞ্জারের তাই প্রোটিনের জেনেটিক কোডের দিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন । তবে ১৯৪৪ সালে অ্যাভারি, ম্যাক্লিওড এবং ম্যাক্কার্থী মিলে ব্যাক্টেরিয়াল ট্রান্সফরমেশনের(টেকনিক্যাল টার্ম) মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে, প্রোটিন নয়, ডিএনএ ই হলো জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল (সাইটেশন ৩)।
বিজ্ঞানীরা তখন জানেন যে, এমআরএনএ তথা ডিএনএ তেই জেনেটিক কোড বিদ্যমান ( এমআরএনএ হলো ডিএনএ এর বার্তাবাহক )। এরপরের প্রশ হলো- এমআরএনএ তে তো চারটি অক্ষর রয়েছে- A,U,G,C. এই চারটি অক্ষর মিলে কিভাবে জেনেটিক কোডের সৃষ্টি করে? এমআরএনএ এর কয়টি অক্ষর মিলে একটি অ্যামিনো এসিডের জন্য কোড করবে?
বিজ্ঞানীরা তখন জানেন যে, জীবদেহের কোষে বিশটি এমিনো এসিড রয়েছে। তাই জেনেটিক কোড যেমনই হোক না কেন, বিশটি এমিনো এসিড কোড করার মতো অন্ততপক্ষে বিশটি স্বতন্ত্র জেনেটিক কোড প্রয়োজন।
এমআরএনএ এর চারটি অক্ষর থেকে যদি দুইটি করে অক্ষর নিয়ে একেকটি কোড হয়, তাহলে সর্বমোট সম্ভাব্য কোডের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬, যা ২০ টি এমিনো এসিডকে কোড করার জন্য যথেষ্ট নয়। যদি চারটি অক্ষর থেকে যদি দুইটি করে অক্ষর নিয়ে একেকটি কোড হয়, তাহলে তাহলে সর্বমোট সম্ভাব্য কোডের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৪, যা ২০ টি এমিনো এসিডের চেয়ে দরকারী কোডের চেয়ে বেশী। কোডের সংখ্যা বেশী হলে তো সমস্যা নেই, কিন্তু কম হলে সমস্যা। তাই জেনেটিক কোড অন্ততপক্ষে তিনটি অক্ষর নিয়ে হতে হবে। একেকটি জেনেটিক কোডের নাম দেয়া হলো ‘কোডন’ (codon)।
এরপরের প্রশ্ন হলো, কোন ‘কোডন’ কোন এমিনো এসিডের জন্য কোড করে?
এই প্রশ্নের উত্তর আসা শুরু করলো মোটামুটি দীর্ঘ সময় ধরে।
জীবকোষের বাইরে যদি কৃত্রিমভাবে জীবকোষের পরিবেশ তৈরি করে এক্সপেরিমেন্ট করা হয়, এরকমভাবে করা এক্সপেরিমেন্টগুলোকে বলা হয় ‘ইন ভিট্রো’ এক্সপেরিমেন্ট । এরকম একটি পরীক্ষার মাধ্যমে এরপরের প্রথম বড় ব্রেকথ্রু নিয়ে আসেন নিরেনবার্গ এবং ম্যাথিউ, ১৯৬১ সালে।
মার্শাল নীরেনবার্গ। সর্বপ্রথম জেনেটিক কোড ‘ডিকোড’ করেছিল তার দল।
তারা ‘নিউক্লিওটাইড ফস্ফোরাইলেজ’ নামক এনজাইমের(সকল এনজাইম হলো প্রোটিন) সাহায্য এমন এক এমআরএনএ সংশ্লেষণ করলেন, যা শুধু ইউরাসিল(U) দিয়ে গঠিত, এবং যাতে আরএনএ এর অন্য তিনটি অক্ষর পুরোপুরি অনুপুস্থিত। যেহেতু Poly U এমআরএনএ তে শুধু UUU ট্রিপলেট বা কোডন রয়েছে, এটি শুধু সেই এমিনো এসিডকেই কোড করবে যা এই UUU কোডনের জন্য সুনির্দিষ্ট।
সাধারণ এমআরএনএ এর নমুনা সিকুয়েন্সঃ AUGCCCGUUAUGCA….
Poly U এমআরএনএ এর নমুনা সিকুয়েন্স ঃ UUUUUUUUUUUUU….
পরীক্ষাঃ বিশটি টেস্ট টিউবে প্রোটিন সিন্থেসিসের জন্য যাবতীয় উপকরণ দেয়া হলো( ব্যাক্টেরিয়ায় কোষের অঙ্গানুসমুহ, প্রয়োজনীয় রাসায়নিক শক্তি )। বিশটি টেস্ট টিউবের প্রত্যেকটিতে ২০ টি আলাদা অ্যামিনো এসিডের মিশ্রণ দেয়া হলো, এবং প্রত্যেক টিউবে মাত্র একটি করে তেজস্ক্রিয় কার্বনের অ্যামিনো এসিড দেয়া হলো। ধরা যাক, ১ নম্বর টিউবে এক্স অ্যামিনো এসিডটি তেজস্ক্রিয়, এবং বাকি সব অ্যামিনো এসিড সাধারণ। ২ নম্বর টিউবে ওয়াই অ্যামিনো এসিডটি তেজস্ক্রিয়, কিন্তু এক্স সহ বাকি সব অ্যামিনো এসিড সাধারণ। যদি কোন টিউবে কোন তেজস্ক্রীয় পেপটাইড সিন্থেসিস হয়, তাহলে বোঝা যাবে যে সেই Poly U এমআরএনএই এই পলিপেপটাইডের সিন্থেসিসের জন্য দায়ী।
নীরেনবার্গ এবং ম্যাথিউ পরীক্ষা করে আবিষ্কার করলেন, তাদের এই Poly U এমআরএনএ এমন এক পলিপেপটাইডকে কোড করছে, যাতে শুধু ‘ফিনাইলঅ্যালানিন’ নামক এমিনো এসিড রয়েছে।
এরপর তারা Poly C, poly A এমআরএনএ সিন্থেসিস করে যথাক্রমে ‘প্রোলিন’ এবং ‘লাইসিন’ নামক এমিনো এসিডের পলিপেপটাইড সিন্থেসিস করলেন। Poly G এর সাহায্য তখনো কোনো পলিপেপটাইড সিন্থেসিস করা সম্ভব হলো না, কারণ Poly G এর এমআরএনএ আরও জটিল কমপ্লেক্স তৈরি করছিল, যা তার ‘ট্রান্সলেশনে’র পক্ষে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
তখনো বিজ্ঞানীদের কাছে কৃত্রিমভাবে এমআরএনএ সংশ্লেষণের জন্য কোন পদ্ধতি জানা ছিল না, এবং এই এমআরএনএ তৈরি করার জন্য বিজ্ঞানীরা সাহায্য নিয়েছিলেন ‘নিউক্লিওটাইড ফস্ফোরাইলেজ’ নামক এক এনজাইমের। এই এনজাইমটি নিউক্লিওটাইডের অনুপাত অনুসারে নিউক্লিওটাইডের পলিমার তৈরি করতো। যদি আপনি শুধু U নিউক্লিওটাইড সরবরাহ করেন, তাহলে শুধু Poly U পলিমার তৈরি হবে। যদি শুধু A সরবরাহ করেন, তাহলে শুধু Poly A তৈরি হবে।
ধরা যাক, আপনি পাঁচভাগ A এর সাথে একভাগ C সরবরাহ করলেন। এর ফলে যে পলিমার (এমআরএনএ) তৈরি হবে, তাতে ছয়ভাগের পাঁচভাগ অ্যাডেনিন(A) এর সাথে ছয়ভাগের একভাগ সাইটোসিন(C) থাকবে। এই এলোমেলো পলিমারে AAA ট্রিপলেট থাকবে সবচেয়ে বেশি, AAC, ACA এবং CAA থাকবে আরেকটু কম(যেহেতু C এর অনুপাত A এর চেয়ে কম)। এবং ACC,CCA, CAC থাকবে আরও কম , এবং সবচেয়ে কম থাকবে CCC।
তার মানে হলো, এই পলিমারকে সিন্থেসিস করলে যে পলিপেপটাইড তৈরি হবে, তাতে AAA কোডন যে অ্যামিনো এসিডকে কোড করবে, সেই অ্যামিনো এসিডের পরিমাণ থাকবে সবচেয়ে বেশি। এবং CCC যে যে অ্যামিনো এসিডকে কোড করবে, সেই অ্যামিনো এসিডের পরিমাণ থাকবে সবচেয়ে কম। এভাবে কোন অ্যামিনো এসিডকে কোড করছে, আমরা সেটা বের করতে পারবো।
এরকম বিভিন্ন অনুপাতে A,U,G,C সরবরাহ করে এমআরএনএ তৈরি করে বিজ্ঞানীরা প্রায় সব কোডনগুলো চিহ্নিত করে ফেললেন। তবে, এখানে যেটা সমস্যা ছিল তা হলো, আমরা একেকটা কোডের নিউক্লিওটাইড বেসের সঠিক বিন্যাস বের করতে পারতাম না।
যেমন, আপনি পাঁচভাগ A এর সাথে একভাগ C সরবরাহ করলেন। এই এলোমেলো এমআরএনএ পলিমারে AAA ট্রিপলেট কোডন থাকবে সবচেয়ে বেশি, AAC, ACA এবং CAA থাকবে আরেকটু কম।
এতে করে, আপনি AAA কোডন কোন এমিনো এসিডকে কোড করছে সেটা বের করতে পারবেন ঠিকই, কারণ যে পেপটাইডটি এই এমআরএনএ দিয়ে সিন্থেসিস হবে, তাতে সেই অ্যামিনো এসিডই সবচেয়ে বেশি থাকবে। তবে, AAC, ACA এবং CAA- এই তিনটি ট্রিপলেট প্রায় সমপরিমাণে থাকবে। এই তিনটি ট্রিপলেট যদি যথাক্রমে X,Y,Z অ্যামিনো এসিডকে কোড করে থাকে, তাহলে আমাদের সংশ্লেষিত হওয়া পেপ্টাইডে এই তিনটি অ্যামিনো এসিডই সমপরিমাণে থাকবে। আপনি কিভাবে বুঝবেন যে ঠিক কোন কোডনটি কোন অ্যামিনো এসিডকে কোড করছে?
এই সমস্যার সমাধান করলেন হর গোবিন্দ খোরানা, কৃত্রিমভাবে এমআরএনএ সংশ্লেষণের প্রক্রিয়া আবিষ্কার করে।
হর গোবিন্দ খোরানা।
খোরানা সুনির্দিষ্ট সিকুয়েন্সের এমআরএনএ কৃত্রিমভাবে তৈরি করেন , যাতে আগের মতো এলোমেলো নিওক্লিওটাইড বেসের সিকুয়েন্সের বদলে নিউক্লিওটাইড সিকুএন্সের সুনির্দিষ্ট রিপিট বা পুনরাবৃত্তি ছিল। যদি কোন এমআরএনএ তে AC এর রিপিট থাকে, তাহলে এর সিকুয়েন্সটা হবে এরকমঃ
(AC)n = ACACACACACACACACACACACACACACACACACACACACACACACACACAC….
আপনি যদি এই পুরো সিকুয়েন্স মনোযোগ দিয়ে পড়েন, তাহলে দেখবেন এই পুরো সিকুয়েন্সে শুধু মাত্র দুইটা কোডনের সিকুয়েন্স রয়েছে।
(AC)n = ACA CAC ACA CAC ACA CAC ACA CAC ACA CAC ACA CAC ACA CAC ACA CAC ACA ….
১ নম্বর কোডনঃ ACA
২ নম্বর কোডনঃ CAC
৩ নম্বর কোডনঃ ACA
৪ নম্বর কোডনঃ CAC
এই সিকুয়েন্স থেকে পাওয়া ডাটা আমরা নীরেনবার্গ এবং তার দলের পাওয়া আগের ডাটার সাথে মিলিয়ে পরিপূর্ণ কোডন সিকুয়েন্স বের করতে পারি। উপরের এই কৃত্রিমভাবে সংশ্লেষিত এমআরএনএ দিয়ে যে পলিপেপটাইডটি সংশ্লেষিত হয়েছে, তাতে থ্রিওনিন এবং হিস্টিডিন নামের দুটি অ্যামিনো এসিড সমপরিমাণে আছে। এতে করে আমরা বুঝতে পারি, ACA এবং CAC এর মধ্যে একটি হলো থ্রিওনিনের কোডোন, আরেকটি হলো হিস্টিডিনের কোডোন। আমরা নীরেনবার্গের দলের পাওয়া তথ্য থেকে জানি যে, হিস্টিডিনের কোডে একটা A এবং দুইটা C আছে(ACC,CAC অথবা CCA)। এখানে যেহেতু আমরা হিস্টিডিন পাচ্ছি, সুতরাং, CAC হলো হিস্টিডিনের কোডোন। এবং, অন্যটি(ACA) হলো থ্রিওনিনের কোডোন।
এভাবে, ১৯৬৬ সালের মধ্যে বিজ্ঞানীরা ৬৪ টা কোডোনের সবকটার সঙ্কেতই উদ্ধার করে ফেললেন। ‘জেনেটিক কোডের ব্যাখ্যা এবং প্রোটিন সংশ্লেষণে এর ভূমিকা আবিষ্কারের জন্য খোরানা এবং নীরেনবার্গকে ১৯৬৬ সালে নোবেল প্রাইজ দেয়া হয়।
৬৪ টা জেনেটিক কোডোনের পুর্নাংগ টেবিল।
জেনেটিক কোডোন সর্বমোট ৬৪ টা। প্রত্যেকটা কোডন একটি অ্যামিনো এসিডকে কোড করে, অথচ জীবদেহে অ্যামিনো এসিড রয়েছে মাত্র বিশটা। এর মানে হলো, একই অ্যামিনো এসিডের জন্য একাধিক কোডোন রয়েছে। এজন্য জেনেটিক কোডকে বলা হয় ‘ডিজেনারেট’ কোড।
উপরে লক্ষ্য করে দেখুন যে, সবার উপরে সবার বামের বাক্সটিতে ফিনাইলঅ্যালানিনের(অ্যামিনো এসিড) জন্য দুইটা এবং লিউসিনের(অ্যামিনো এসিড) জন্য এই বক্সে দুইটাসহ তার নিচের বক্সে আরও চারটা কোডোন রয়েছে। এই ছয়টা কোডোনের যে কোন একটি যদি এমআরএনএ তে থাকে, তাহলে এর জন্য পলিপেপটাইড চেইনে লিউসিন যোগ হবে।
সবগুলো কোডোনের সঙ্গেত উদ্ধার হবার পর দেখা গেল, তিনটি কোডোন কোন অ্যামিনো এসিডকেই কোড করে না। এই তিনটি হলো ‘স্টপ কোডোন’ , যা ওই এমআরএনএ থেকে প্রোটিন সিন্থেসিস বন্ধ হবার সংকেত দেয়।
অল্প কিছু ব্যাতিক্রম বাদে জেনেটিক কোড হলো ‘ইউনিভার্সাল’ বা বিশ্বজনীন। অর্থাৎ, আপনার কোষে এমআরএনএ তে UUU থাকলে যেমন প্রোটিনে ফিনাইলঅ্যালানিন যুক্ত হয়, হাতি, মাছি , মৌমাছি, ব্যাকটেরিয়া, গাছ, শিম্পাঞ্জী, মাছসহ পৃথিবীর সকল জীবের ভেতর UUU থাকলে প্রোটিনে ফিনাইলঅ্যালানিন নামক অ্যামিনো এসিডটিই যুক্ত হয়। সকল প্রাণ যে একই আদি প্রাণ থেকে উৎপত্তি,
সাইটেশনঃ
১। “Initial sequencing and analysis of the human genome”. Nature. 409 (6822): 860–921.
২। Crick, F.H.C. (1958). “On Protein Synthesis”.
৩। Avery, Oswald T.; Colin M. MacLeod; Maclyn McCarty (1944-02-01).
রেফারেন্স বইঃ
১। Principles of Biochemistry: Nelson & Cox, 5th eiditon
২। Principles of Genetics: Snustad Simmons, 4th edition.
No comments:
Post a Comment