বনসাই এর যত্ন সাধারনত যতটা কঠিন ধারনা করা হয় আসলে ততোটা কঠিন নয়। তবে, যেহেতু বনসাইকে একটা ছোট পাত্রের মাঝে বেড়ে উঠতে দেয়া হয় তাই এর যত্ন সম্পর্কে কিছু সাধারন নিয়মাবলী রয়েছে যেমন, পানি দেয়া, সার প্রয়োগ, এক টব থেকে অন্য টবে স্থানান্তরিত করা ইত্যাদি।
যেহেতু, বনসাই গাছ গুলো অন্যান্য গাছ সমূহ থেকে কিছুটা নমনীয় তাই এদের যত্ন এবং রক্ষণাবেক্ষণ এ কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। নিম্নে বনসাই গাছ এর সঠিক পরিচর্যা সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
পানি দেয়াঃ
বনসাই গাছের যত্নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল এতে পানি দেয়া। একটি বনসাই গাছে কি পরিমানে এবং কিভাবে পানি দিতে হবে তা অনেক গুলো বিষয়ের উপর নির্ভর করে, যেমন গাছের প্রজাতি, আকার এবং আবহাওয়া এর উপর নির্ভর করে বনসাই গাছে পানি দিতে হয়। গাছে প্রতিদিনই পানি দেয়ার প্রয়োজন হয় না তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন মাটি শুষ্ক না হয়, মাটি সামান্য শুষ্ক হয়ে গেলেই এতে পানি দেয়ার প্রয়োজন হয়ে পরে, তাই মাটিকে কোন ভাবেই সম্পূর্ণ রূপে শুষ্ক হতে দেয়া যাবে না।
নিম্নের সাধারন নিয়মাবলী অনুসরণ করে খুব সহজেই একটি বনসাই গাছে সঠিক পরিমানে পানি দেয়া যায়ঃ
মাটি যখন কিঞ্চিত শুষ্ক হয়ে যাবে তখনই পানি দিতে হবে
এর মানে বনসাই গাছের মাটি কিছুটা ভেজা থাকলেও এতে পানি প্রদান করা যাবে না বরং তা যখন কিঞ্চিত শুকিয়ে আসবে তখন এতে পানি দেয়া যাবে। আঙুল দিয়ে মাটির এক সেন্টিমিটার (০.৪”) গভীর পর্যন্ত ভিতরের শুষ্কতা পরীক্ষা করা যায়
সকল বনসাই এ নির্দিষ্ট সময়ে পানি প্রদান করা যাবে না
সকল বনসাই গাছের প্রতি আলাদা নজর রাখতে হবে, প্রতিটি গাছে আলাদা আলাদা সময়ে পানি দিতে হবে, যখন যে গাছের প্রয়োজন তখন সে গাছে পানি দিতে হবে।
মাটির সঠিক মিশ্রণ
মাটির মিশ্রণের উপর বনসাই গাছের পানি প্রয়োগ অনেকাংশে নির্ভর করে। অধিকাংশ বনসাই গাছের জন্য কাদামাটি, মিহি নুড়ি পাথর এবং জৈব সারের মিশ্রণটি ০.৫:০.২৫:০.২৫ অনুপাতে থাকলে ভালো হয়।
বনসাই গাছে পানি দেয়ার সময়টা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়, যখনই মনে হবে মাটি আংশিক শুকিয়ে আসছে তখনি গাছে পানি দিতে হবে। তবে পরামর্শ হল, বিকেল বেলায় অতিরিক্ত ঠাণ্ডা পানি না দেয়া, যখন মাটি সূর্যের তাপে গরম হয়ে উঠবে তখনি গাছে ঠাণ্ডা পানি দেয়া যেতে পারে।
বনসাই গাছে যখনই পানি দেয়া হয় তখন এমন ভাবে দেয়া উচিত যেন গাছের মূল খুব সহজেই পানি শুষে নিতে পারে। তাই ততক্ষণ পর্যন্ত পানি দিতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না পানি পাত্রের নিষ্কাশন ছিদ্র দিয়ে বের হয়ে আসছে, এই পদ্ধতিতে কিছুক্ষণ পর পর পানি দিতে হবে। একটি গাছের উপর থেকে খুবই মসৃণ ছিদ্র যুক্ত পানি দেয়ার পাত্র দিয়ে পানি দিতে হবে, এর ফলে মাটির কোন ক্ষতি হবে না। ধরে রাখা বৃষ্টির পানি গাছের জন্য অনেক ভালো, যদি না এতে কোন প্রকার রাসায়নিক পদার্থ যুক্ত করা হয়।
সার প্রয়োগ
যেহেতু বনসাই গাছ কে একটি স্থান থেকে সংগ্রহ করে অন্য পাত্রে স্তাপন করা হয় তাই এর প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সমুহ পুনরায় ফিরে পাওয়ার জন্য এতে সঠিক ভাবে এবং সঠিক সময়ে সার প্রদান করতে হয়। “বনসাই সার” ব্যাবহার করাই শ্রেয় তবে যেকোনো ভালো সার ব্যাবহার করা যায়, তবে খেয়াল রাখতে হবে তা যেন পরিমানে খুব বেশি না হয়।
বনসাই এর সঠিক ভাবে বেড়ে উঠার জন্য এদেরকে নিয়মিত খাবার দেয়া অতি জরুরি। সাধারন গাছ সমূহ তাদের মূলকে মাটির অনেকটা অভ্যন্তরে বিস্তার করার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান সংগ্রহ করে। যেহেতু, বনসাই কে একটি ক্ষুদ্র পাত্রে স্থাপন করা হয় তাই এদের পক্ষে প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পরে। এদেরকে সার প্রদানের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় খাবারের অভাব পূরণ করতে হয়।
যেকোনো সারে ৩ টি প্রধান উপকরণ থাকে নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পটাশিয়াম আর এই প্রত্যেকটি উপাদানই আলাদা আলাদা কারণে ব্যাবহার করা হয়। নাইট্রোজেন পাতা এবং কাণ্ডের বর্ধনে সাহায্য করে, ফসফরাস স্বাস্থ্যবান মূল গঠনে এবং পটাশিয়াম ফুল ও ফলের বর্ধনে সহায়তা করে। বনসাই কে সার প্রদান করার সময় বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে একে এনপিকে (নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পটাশিয়াম) প্রয়োগ করতে হয়, যা এর বর্ধনের জন্য খুব দরকার।
বসন্তের শুরু থেকে শরতের মাঝামাঝি পর্যন্ত বনসাই এর বর্ধন কালীন সময়ে সবসময়ই সার দিতে হয়। ঘরের অভ্যন্তরের গাছ গুলোতে সবসময়ই সার দিতে হয়। তবে একটি বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে, পাত্রে স্থাপনের এক মাস অব্দি গাছে সার প্রয়োগ করা যায় না।
বনসাই গাছের জন্য সঠিক সার বাছাই করাটা অতি গুরুত্বপূর্ণ। বসন্তের শুরুতেই গাছের বৃদ্ধিকে তরান্বিত করার জন্য অধিক নাইট্রোজেন সম্বলিত সার দিতে হবে (এর অনুপাত হতে পারে এনঃপিঃকে=১২:৬:৬)। গ্রীষ্মের সময় সকল উপাদান সমপরিমাণে আছে এমন সার ব্যাবহার করতে হবে। যেমন এর অনুপাত হতে পারে, এনঃপিঃকে=১০:১০:১০। এবং শরৎ কালে গাছকে আগত শীতের জন্য শক্তিশালী করে তোলার লক্ষে এনঃপিঃকে=০৩:১০:১০ এই অনুপাতের সার ব্যাবহার করা যেতে পারে।
তবে এর বেতিক্রম হতে পারে, যদি গাছে দ্রুত ফুল ফুটানো প্রয়োজন হয় তবে গাছে অধিক নাইট্রোজেন সম্বলিত সার দিতে হবে এবং গাছ যদি অনেক পুরাতন হয় তবে খেয়াল রাখতে হবে সারে নাইট্রোজেন এর পরিমান যেন কিছুটা কম থাকে। যদিও, “বনসাই সার” অন্যান্য সারের মতই তবে এই সার প্রয়োগে এর উপাদান সমুহের সঠিক বিন্যাস পাওয়া যায়। ব্যাবহার করার জন্য সারের তরল কিংবা কঠিন আকার কোন ব্যাপার না তবে সারের প্যকেটে দেয়া নির্দেশাবলী সঠিক ভাবে পালন করতে হবে।
বনসাই এ সার প্রদানের সময় এর প্যাকেটে বর্ণিত নির্দেশাবলী অনুযায়ী মাত্রা এবং পরিমান নির্ণয় করতে হবে। তবে যে সকল গাছ বনসাই এর প্রাথমিক পর্যায়ে আছে তাদের ক্ষেত্রে প্রদত্ত নির্দেশাবলীর থেকে কিছুটা কম মাত্রার সার প্রদান করতে হয় যেন তাদের বেড়ে উঠার মাত্রা ঠিক থাকে।
বনসাইকে পাত্রে স্থাপনঃ
গাছকে পাত্রে আবদ্ধ করে রেখে এবং অবশেষে একে নষ্ট করে ফেলতে না চাইলে এর নিয়মিত পাত্র প্রতিস্থাপন করতে হবে। পাত্রে প্রতিস্থাপনের ফলে বনসাই এর আকার ছোট হয়ে যায় না বরঞ্চ এর ফলে গাছ নিয়মিত নতুন খাদ্য উপাদান পায় যা একে বেড়ে উঠতে এবং দ্রুত ফুল ধরতে সাহায্য করে।
বনসাই কে পাত্রে প্রতিস্থাপনের বিষয়টি নির্ভর করে একে যে পাত্রে রাখা হয়েছে তার আকারের উপর এবং গাছের প্রজাতির উপর। দ্রুত বর্ধনশীল গাছকে প্রতি দুই বছর অন্তর অন্য পাত্রে প্রতিস্থাপন করতে হয় এমনকি কোন কোন গাছকে প্রতি বছর পাত্রে প্রতিস্থাপন করতে হবে। যেখানে, অধিক পুরাতন এবং পরিনত গাছকে প্রতি ৩ থেকে ৫ বছর অন্তর অন্তর অন্য পাত্রে প্রতিস্থাপন করতে হয়। পাত্রে প্রতিস্থাপন করার কোন নির্দিষ্ট সময় নেই তবে বসন্তের শুরুতেই গাছের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে এবং প্রয়োজন পরলে সেই সময়ই গাছকে অন্য পাত্রে প্রতিস্থাপন করতে হবে।
বসন্তের শুরুতেই বনসাইকে পাত্রে প্রতিস্থাপন করতে হয় কারন তখন গাছ গুলো সুপ্ত অবস্থায় থাকে। এই সময় প্রতিস্থাপন করলে গাছের ক্ষতি কম হয় এবং যদিও নুন্যতম কোন ক্ষতি হয়ও তা গাছ দ্রুত পুষিয়ে উঠতে পারে।
এই ক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে একটি বনসাই কে অন্য পাত্রে প্রতিস্থাপন কে ২ ভাগে ভাগ করা যায়-
১.Training pot to another training pot
২.Training pot to bonsai pot
প্রথমে বনসাই এবং টবের front side নির্বাচন করব । এরপর ট্রেনিং pot থেকে বনসাইকে তুলে হুকের সাহায্যে বনসাইয়ের শিকড় বের করব । এতে সুবিধা হল গাছের নিচে অনেক সুন্দর সুন্দর শিকড় থাকতে পারে । যা বনসাইকে আরো বেশি আকর্ষনীয় করে তুলতে পারে । এর পর বনসাইয়ের অপ্রয়োজনীয় শিকড় গুলো কেচির মাধ্যমে কেটে নিব ।
এখন বনসাই এবং পটের front সমন্নয় করে পটের তলা থেকে তার দিয়ে বনসাইয়ের গোড়ার শিকড়ের সাথে ভাল ভাবে বেঁধে নিব , যাতে করে বনসাইটি বাতাসে বা ঝড়-বৃষ্টিতে টব / Bonsai pot থেকে বিচ্ছিন্ন হতে না পারে । এরপর বনসাইয়ের গোড়ায় ভালভাবে সার মাটি দিব ,যাতে শিকড়ের মাঝে কোথাও কোন ফাঁকা না থাকে ।এখন বনসাইটিকে ছায়া যুক্ত স্হানে ১-২ সপ্তাহ রাখব।আরো ১ সপ্তাহ দিনের অর্ধেক বেলা রৌদ্র , অর্ধেক বেলা ছায়া এমন স্হানে রাখব । পরবতী সপ্তাহ অথাৎ ২১ দিন পর আস্তে আস্তে পূর্ণ রৌদ্রে নিয়ে আসব , এসময় বনসাইকে প্রয়োজনমতো ২-৩ বেলা পানি দিব । এভাবে আমরা একটি বনসাইকে ট্রেনিং টব/পট থেকে বনসাই পটে স্হানান্তর করতে পারি ।
No comments:
Post a Comment