পশ্চিমবঙ্গের পাঁচটি রাজবাড়ীর অতীতের অজানা কাহিনী:
১. তমলুক রাজবাড়ী:
২. মহিষাদল রাজবাড়ী:
৩. ময়নাগড়:
৪. নাড়াজোল রাজবাড়ী:
৫. আন্দুল রাজবাড়ী:
এটা ঠিক নিছক ভ্রমন কাহিনী নয়। এটি একটি অন্বেষন। ফেলে আসা অতীতের খোঁজ। কিছুদিন ধরেই মনে হচ্ছিল আমাদের কাছাকাছি জেলাগুলিতে অবস্থিত পুরানো রাজবাড়ীগুলোর অস্তিত্ব আর তার ইতিহাসের কথা জানতে। রাজবাড়ী গুলো ঘুরতে ঘুরতে আমার মনে হয়েছিল জেলা ভিত্তিক রাজবাড়ীগুলিকে নিয়ে পর্যটনের একটা বড় সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু দরকার একটু সরকারী সহয়তা, রাজবাড়ীগুলোর সংস্কার এবং তাদের ঠিকমত প্রোজেক্ট করার সদ্ইচ্ছা। হেরীটেজ বিল্ডিং ঘোষিত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র সরকারী উদাসীনতা এবং অজ্ঞতার কারনে বাংলার ৫০০ থেকে ১০০০ বছরের পুরানো ইতিহাস গুলো আজ ধংসের পথে। তাই আমাদের মনে হল এই ওপেন ফোরামে এটা হাইলাইট করা উচিৎ। আজকের উপস্থাপনায় মূলতঃ পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তিনটি রাজবাড়ী, ময়নাগড়, মহিষাদল এবং তমলুক, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার একটি- নাড়াজোল ও হাওড়া জেলার একটি রাজবাড়ী, আন্দুল রাজবাড়ীর উল্ল্যেখ থাকছে। দীর্ঘ ইতিহাস রচনায় না গিয়ে আসুন সংক্ষেপে আপনাদের রাজবাড়ীগুলোর সঙ্গে একটু পরিচয় করিয়ে দিই।
১. তমলুক রাজবাড়ী:
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক শহরের কেন্দ্র স্থলে অবস্থিত এই তমলুক রাজবাড়ী। সড়ক পথে কলকাতা থেকে দূরত্ব ১০৫ কিমি।
১৩শ শতাব্দীতে কালু ভুঁইজ্ঞা এই রাজত্বের প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু পরবর্তীতে ১৬শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে মোঘল সম্রাটের কাছ থেকে পুরস্কার স্বরূপ এনারা “রায়” উপাধি পান। এবং তখন থেকে এনারা “রায়” উপাধি-ই ব্যবহার করে আসছেন। এই রাজবাড়ীতে ১৯৩৮ সালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু এসেছিলেন। বর্তমানে এই রাজবাড়ীটি পুরোটাই প্রায় ধংস্ব প্রাপ্ত। ছাদ এবং পলেস্তারা খসে যাওয়া পুরানো প্রাচীন ইমারতটি শুধু ইতিহাসের স্বাক্ষী বহন করে আসছে।
২. মহিষাদল রাজবাড়ী:
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক মহুকুমায় অবস্থিত এই রাজবাড়ী। কলকাতা থেকে দূরত্ব ১১০ কিমি। NH6 এবং হলদিয়া এক্সপ্রেস ওয়ে ধরে পৌঁছানো যায় এই রাজবাড়ীতে। আনুমানিক ১৫৫৭ খৃষ্টাব্দে জর্নাদন উপাধ্যায় (যিনি আগে সম্রাট আকবরের অধীনে সেনা বিভাগের উচ্চ কর্মচারী ছিলেন) উত্তরপ্রদেশ থেকে মেদিনীপুরের গেঁওখালিতে এসে উপস্থিত হন। এবং কিছুদিনের মধ্যেই তৎকালীন জমিদার কল্যান রায়চৌধুরীর কাছ থেকে জমিদারি কিনে নেন। এই বংশের পঞ্চম পুরুষ আনন্দলাল উপাধ্যায় পুত্রহীন হওয়ায় ওনার মৃত্যুর পরে ওনার স্ত্রী জানকী দেবী ওনাদের দৌহিত্র গুরুপ্রসাদ গর্গকে সমস্ত রাজ্যপাট দান করেন। এবং সেই থেকে গর্গ-রাই এই বংশের উত্তরাধিকারী হন। এই রাজবংশের তিনটি রাজবাড়ীর উল্ল্যেখ পাওয়া যায়। তার মধ্যে প্রথমটি অবলুপ্ত। দ্বিতীয় রাজবাড়ীর নাম রঙ্গীবসান বা সিংহদুয়ার যা বর্তমানে ভগ্নপ্রাপ্ত। এবং তৃতীয় রাজবাড়ীটির নাম ফুলবাগ (চিত্রে) যা এখনও পর্যন্ত খুব যত্নে সংরক্ষিত আছে।
এ ছাড়াও গ্রীষ্মাবাসের জন্য জল বাংলো বা লালকুঠী এখনও বিদ্যমান। বর্তমানে এখনও এখানে রাজ পরিবারের সদ্যদরা থাকেন। ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের বড় অনুরাগী ছিলেন এই রাজ পরিবার। এখানে উস্তাদ আলি আকবর খাঁ, উস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ সাহেবের মত ভারত বিখ্যাত শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন।
৩. ময়নাগড়:
কলকাতা থেকে ১০০ কিমি দূরে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় অবস্থিত এই রাজবাড়ী। হলদিয়া এক্সপ্রেস ওয়ে দিয়ে গিয়ে নিমতৌড়ী থেকে ১২ কিমি গেলেই এই রাজবাড়ী। ১০০০ বছরের পুরানো এই গড় মূলতঃ লাউসেনের গড় বলেই প্রচলিত। গৌড়েশ্বর দ্বিতীয় মহিপালের রাজত্বকালে ( ৯৮৮-১০০৮খ্রি) বাংলার সেনভূম ও গোপভূম অঞ্চল শাসন করতেন কর্নসেন। কিন্তু ইছাই ঘোষের কাছে পরাজিত হয়ে এবং যুদ্ধে ৬ সন্তানকে হারিয়ে শোকাতুর কর্নসেন গৌড়েশ্বরের আশ্রয় গ্রহন করেন। তখন গৌড়েশ্বর তাঁকে দক্ষিনবঙ্গের ময়নামন্ডল রাজত্ব দেন। পরবর্তীকালে যা ময়নাগড় নামে বিখ্যাত হয়। পরবর্তীকালে কর্নসেনের দ্বিতীয় ধর্মপত্নী রঞ্ঝাবতী লাউসেনের জন্ম দেন। মনসামঙ্গল কাব্যেও লাউসেনের উল্ল্যেখ আছে। লাউসেন বড় হয়ে ইছাই ঘোষের কাছ থেকে পিতৃরাজ্য সেনভূম উদ্ধার করেন। এবং পরবর্তীতে লাউসেন হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেন। তাই তিন ধর্মের মানুষের কাছেই এ জায়গা বড় পবিত্র। মধ্যের চারশো বছরের ইতিহাস সেরকম ভাবে জানা যায় না। পরবর্তীতে সামন্ত বংশের পঞ্চম পুরুষ গোবর্ধন সামন্ত উৎকল রাজকে রাজস্ব দিতে অস্বীকার করায় রাজার সঙ্গে ওনার প্রবল যুদ্ধ হয। এবং যুদ্ধে উনি পরাজিত ও বন্দী হন। কিন্তু উৎকলরাজ ওনার সাহসিকতা এবং বীরত্বে সন্তুষ্ট হয়ে “বাহুবলীন্দ্র” উপাধি প্রদান করেন। এবং ময়নাগড় রাজত্ব হিসাবে পান। বর্তমানে গড়ের পুরানো কেল্লার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। তবে পরবর্তীতে বাহুবলীন্দ্র রাজাদের হাতে তৈরী রাজবাড়ীর অনেকটা অংশই এখনও বিদ্যমান যদিও পরিতক্ত্য অবস্থায় পড়ে আছে। হেরিটেজ বিল্ডিং ঘোষিত হওয়া সত্তেও এখনো পর্যন্ত কোনো সরকারী অনুদান না পাওয়ায় তা হয়ত একদিন ধ্বংসস্তুপে পরিনত হবে।
মাকড়দহ ও কালিদহ নামে দুই বিস্তির্ন পরিখা দিয়ে ঘেরা এই গড় একসময় খুবই সুরক্ষিত ছিল এবং দুই পরিখার মধ্যে ঘন কাঁটা বাঁশের ঝোপ ছিল। যেখান দিয়ে শত্রুর প্রবেশ অসাধ্য ছিল। এবং এখনো পর্যন্ত রাজবাড়ীতে প্রবেশ করতে গেলে নৌকা করে কালিদহ পেরিয়ে তবেই প্রবেশ সম্ভব।
৪. নাড়াজোল রাজবাড়ী:
এটি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার একটি খুবই সম্ভ্রান্ত রাজবাড়ী। কলকাতা থেকে দূরত্ব ১২০ কিমি। NH6 ধরে পাঁশকুড়া ছাড়িয়ে গিয়ে ডানদিকে লোয়াদা-আশারিবাদ রোড ধরে গিয়ে কংসাবতী নদী পেরিয়ে গেলেই এই রাজবাড়ী। এছাড়াও ঘাটাল-দাশপুর হয়েও যাওয়া যায়। প্রায় ৪০০ বছর আগে উদয় নারায়ন ঘোষ এই রাজবাড়ীর প্রতিষ্ঠা পুরুষ। পরবর্তীকালে বাংলার নবাবের কাছ থেকে উপহার স্বরূপ ওনারা “খান” উপাধি লাভ করেন। এই রাজবাড়ীতে একসময় গান্ধীজি, জওহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী, সুভাষ চন্দ্র বসুর মত বিখ্যাত ব্যাক্তিরা এসেছেন। ২০০৮ সালে হেরিটেজ বিল্ডিং ঘোষিত হওয়া সত্ত্বেও কোনো অনুদান এখনও পর্যন্ত এই রাজবাড়ীর জন্য আসেনি।
৫. আন্দুল রাজবাড়ী:
এটি হাওড়া জেলায় অবস্থিত। কলকাতা থেকে থেকে দূরত্ব ৩০ কিমি। ১৭শ শতাব্দীর শেষ ভাগে রাজা কাশীনাথ রায় এই রাজবাড়ী প্রতিষ্ঠা করেন। এনারা বর্ধমান রাজার অধীনে সামন্ত রাজা ছিলেন। বর্তমানে এই রাজবাড়ী অনেকটাই দখলিকৃত। অনেক জায়গায় রাজ বাড়ীর ছাদ ভেঙে পড়েছে পলেস্তারা খসে পড়েছে। শরিকী বিবাদের কারনে এই রাজবাড়ী হেরিটেজ বিল্ডিং হিসাবে ঘোষিত হয় নি। রাজবাড়ীগুলো ঘুরতে ঘুরতে কতকগুলো জিনিস চোখে পড়েছিল।
ক) প্রত্যেক রাজবাড়ীর স্থাপত্য শৈলীর মধ্যে গথিক স্টাইলের বড় বড় থাম রাজবাড়ীর সামনের দিকে থেকে entire architectural pressure load টা balance করত এবং সৌন্দর্য্য বাড়াত। প্রত্যেকটা থাম শুধুমাত্র বিভিন্ন সেপের ইঁট দিয়ে তৈরী।
খ) প্রত্যেক রাজবাড়ীর সুরক্ষার দিকটা খুব আঁটোসাঁটো ছিল। এবং রাজবাড়ীগুলোর পাশ দিয়ে দীর্ঘ পরিখা খনন করা হত যাতে সহজে শত্রুরা রাজবাড়ী আক্রমন করতে না পারে। নাড়াজোল, মহিষাদল, ময়নাগড় তিনটে রাজবাড়ীই পরিখা দিয়ে ঘেরা ছিল। তবে সুরক্ষার ব্যাপারে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিল ময়নাগড়।
গ) কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে রাজা যাতে নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যেতে পারেন তারজন্য প্রত্যেক রাজবাড়ীতেই একটি করে সুড়ঙ্গ থাকত। ময়নাগড়ে যেরকম ময়নাগড় থেকে কংসাবতী নদী পর্যন্ত। আন্দুলে রাজবাড়ী থেকে সরস্বতী নদী পর্যন্ত। নাড়াজোল এবং মহিষাদলেও সুড়ঙ্গের হদিস আছে।
ঘ) মেদিনীপুরের চার রাজাই ছিলেন মূলতঃ শ্রীকৃষ্ণ ভক্ত। রাজবাড়ী গুলোর যতই অচলাবস্থা থাকুক না কেন ঠাকুরের নিত্য সেবা কিন্তু আজও খুব ভক্তির সঙ্গে হয়ে চলেছে।
সব থেকে উল্ল্যেখযোগ্য যে বৈপরীত্য চোখে পড়বে তা হল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মেদিনীপুর জেলার অসামান্য অবদান ছিল। যেখানে অসহযোগ আন্দোলনের সময় ময়নাগড়ের রাজা পূর্ণানন্দ বাহুবলীন্দ্র তার দামী শাল আগুনে ছুঁড়ে ফেলছেন, আন্দোলনকারীদের অতিথিশালা খুলে দিচ্ছেন স্বরাজ আশ্রম গড়ার জন্য। তমলুকের রাজা সুরেন্দ্র নারায়ন রায় তমলুকের লবন আইন অমান্য আন্দোলনের সহ সভাপতি হিসাবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সুভাষ চন্দ্র বসু সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সময় তমলুক রাজবাড়ীর আতিথ্য গ্রহন করছেন। নাড়াজোলের রাজা দেবেন্দ্রলাল খাঁন এর সময় বিপ্লবীরা রাজবাড়ীর পরিত্যক্ত ঘরগুলিতে গা ঢাকা দিয়ে থাকছে, অস্ত্রভান্ডার গড়ে তুলছে। যেখানে নেতাজী, নেহেরুজি, গান্ধীজি সবাই এসে ঘুরে যাচ্ছেন সেখানে মহিষাদল কি করে মার্গ সঙ্গীতে ডুবে থাকতে পারে! মহিষাদল ছাড়া বাকী তিন রাজাই ছিলেন বাংলার ভূমিপুত্র।
রাজবাড়ীর মধ্যেকার আত্মীয়তা এবং রেষারেষির গল্পও উঠে আসে।
যেরকম ময়নাগড়ের রাধাশ্যামানন্দ বাহুবলীন্দ্র মাত্র ১২ বছর বয়সে পিতা মাতাকে হারিয়ে মানুষ হয়ে ছিলেন তমলুক রাজবাড়ীতে। এবং পরবর্তীতে তমলুকের রাজা লক্ষীনারায়ন রায়ের কন্যার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
ময়নাগড়ের রাজা ব্রজানন্দ ইংরেজদের রাজস্ব মেটাতে ব্যার্থ হয়ে একবার মহিষাদলের রানী জানকী দেবীর কাছে জমিদারির কিয়দংশ বন্ধক রেখেছিলেন অর্থের সংস্থান করতে। কিন্তু রানী সুযোগ বুঝে পুরো ময়নাগড় অধিকার করতে চেয়েছিলেন যদিও পরবর্তীতে তা বুঝতে পেরে ব্রজানন্দ ভেস্তে দিয়েছিলেন। সেই থেকে ময়নাগড় ও মহিষাদলের মধ্যে বিভেদ বিদ্যমান।
No comments:
Post a Comment